কুয়াশার কারণে রোদের দেখা না মেলায় হঠাৎ করে বেড়ে গেছে শীত। রোববার দুপুরের পর থেকে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে বলে আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে। শীতের প্রকোপ থাকতে পারে আরো দু-তিন দিন।
আবহাওয়াবিদ সানাউল হক বলেন, ‘রোববার দুপুরের পর কুয়াশার আধিক্যের কারণে রোদ ওঠেনি। এ কারণে ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা আগের চেয়ে প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে।’ এজন্য শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে আরো জানা গেছে, রোববার দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ১২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
উত্তরের হিমেল হাওয়া আর ঘন কুয়াশার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা উত্তরাঞ্চলে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও। সেখানে গরম কাপড়ের অভাবে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। কনকনে শীতের সঙ্গে যোগ হওয়া ঘন কুয়াশা ঢেকে রাখছে দিনের অর্ধেক সময়।
বিভিন্ন ফসল নষ্টের উপক্রম হচ্ছে শীতের কারণে। দিনের বেলাতেও যানবাহনগুলো চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। কষ্ট হলেও শীত উপেক্ষা করে নিজ নিজ কর্মে যাচ্ছেন দিনমজুর আর শ্রমিকরা। রোদ না থাকায় মিল- চাতালে দিনের পর দিন পড়ে রয়েছে সেদ্ধ করা ধান। আর এটাই হচ্ছে গোটা উত্তরাঞ্চলের চালচিত্র। উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে রাইজিংবিডি প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
মাগুরা প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন শাহীন জানান শীতের তীব্রতায় কাঁপছে মাগুরার মানুষ। রাতে বৃষ্টির মতো শিশির ঝরছে। সূর্যের দেখা মিলছে না। গরিব মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। মানুষজন ছুটছে গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে। শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। বহু স্থানে ঘন কুয়াশার কারণে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাও।
মাগুরা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলায় দুই দিন ধরে ঠিকমতো সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে গরম কাপড়ের অভাবে ঠান্ডায় কাঁপছে উপজেলার দুস্থ ও হতদরিদ্র মানুষ। তারা আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। তিনটি উপজেলায় সরকারিভাবে এ পর্যন্ত কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি।
জেঁকে বসা তীব্র শীতের কারণে লেপ-তোশকের দোকানের পাশাপাশি মার্কেটগুলোতে গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় করছেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ক্রেতারা। আর নিম্নমধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী ক্রেতারা যাচ্ছেন ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা কম দামের শীতবস্ত্র বিক্রেতাদের কাছে। তবে অন্য বছরের চেয়ে এবার কাপড়ের দাম বেশি বলে জানালেন ক্রেতারা।
মহম্মদপুর উপজেলার মধুমতী নদীর পাড়ে জেলেপাড়া গ্রাম। সোমবার সকালে ওই গ্রামে সকাল গিয়ে দেখা যায়, দরিদ্র মানুষ অনেক স্থানে আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের শীত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। গরম কাপড়ের অভাবে ওই গ্রামে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ কষ্টে আছে। এ সময় রহিমা বেগম বলেন, ‘নদীর বাতাস খালি হড়হড় করে এসে ঘরে ঢোকে। গায়ে দেওয়ার একটা মোটা কাপড়ও নাই, বাবা।’
একই গ্রামের সাবিনা বেগম (৩২) বলেন, ‘রাতে কয়দিন থেকে ঘরে বরপের মোতো ঠান্ডা পানি পড়ছে। ঠান্ডায় হাত-পা কোঁকড়া লাগে।’ উপজেলার গোপালনগর রুইজানি গ্রামের শাহনাজ বেগম (৬৫) কাঁপতে কাঁপতে বলেন, ‘মরণের ঠান্ডা শুরু হইছে। কয়দিন থেকে রইদো নাই। এমন কয়দিন থাকবে?’
রায়পাশা গ্রামের মালেকা বেগমা (৫০) বলেন, ‘ গরিবের জন্য গরমে ভালো। পাতলা ছিঁড়া কাপড় গায়ে দিয়া থাকা যায়। ঠান্ডায় মোটা কাপড় নাই। ছাওয়াল-মেয়ে নিয়ে কষ্টো করে বেঁচে আছি। আমাদের মেম্বার-চেয়ারম্যানরা দেখে না।’ পোয়াইল গ্রামের মাজেদা বেগম (৫৫) বলেন, ‘হাত-পা টাটানি ঠান্ডা শুরু হইছে। সহ্য করা যাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছে, ঠান্ডাও বাড়ছে।’
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘উপজেলায় এ পর্যন্ত সরকারিভাবে শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ শুরু হয়নি। কম্বল চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। শীতে অসহায় মানুষকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসা দরকার।’
নীলফামারী প্রতিনিধি ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন জানান, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশার কবলে পড়েছে উত্তরের নীলফামারীসহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো। সোমবার সকাল থেকে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে।
রোববার ভোর থেকে কনকনে শীতের সঙ্গে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা ঢেকে রাখে এলাকা। শীতবস্ত্রের অভাবে বাড়িতে থাকা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন দরিদ্র বৃদ্ধা ও শিশুরা। দিনের বেলাতেও যানবাহনগুলো চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। কষ্ট হলেও শীত উপেক্ষা করে খাদ্যসংকটের কারণে নিজ নিজ কাজকর্মে যাচ্ছেন দিনমজুর আর শ্রমিকরা। রোদ না থাকায় মিল-চাতালে পড়ে রয়েছে সেদ্ধ ধান। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন তিস্তাপাড়ের দরিদ্র মানুষ। শীতে কাবু লক্ষাধিক মানুষ অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। সেখানে আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে মানুষজন।
নীলফামারী শহরের বড় মাঠ, সৈয়দপুর রেললাইন ও ডোমার বাজারের পুরাতন কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় করছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। শীত মোকাবিলায় সরকারিভাবে কিছু কম্বল পাওয়া গেলেও কম্বল, চাদর, শিশু পোশাক মিলে ৮৫ হাজার পিসের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তরে।
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালেব মোল্লা জানান, ইতিমধ্যে ৪১৫১পিচ কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। খুব শীঘ্রই উপজেলাগুলোতে বিতরণ করা হবে কম্বলগুলো।
রাইজিংবিডির পঞ্চগড় প্রতিনিধি হাসিবুল করিম জানান, হিমালয়ের একবারে কাছে অবস্থিত পঞ্চগড় জেলায় রাতে ও সকালে কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে সারা শহর। ক্রমেই তা ভারী হচ্ছে। সন্ধ্যার পরই শুরু হচ্ছে মাঝারি কুয়াশা ও চলে সকাল পর্যন্ত । রাতের বেলা যানবাহনগুলো হেডলাইট নিচু করে চলাচল করছে। রাতের কুয়াশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সকালে সূর্য ওঠার পরও জমির আইল দিয়ে হাঁটলে শরীর ভিজে যাচ্ছে। শিষ বের হওয়া আমন ধানের গাছে সূর্য ওঠার অনেক পর পর্যন্ত শিশির লেগেই থাকছে।
এখানে বিকেল থেকেই শীতল বাতাস আর সন্ধ্যার পরই কুয়াশা ঝরতে শুরু করেছে। মধ্যরাতের পর টিনের চালা থেকে পড়ছে হালকা বৃষ্টির মতো পানি। সকালে গাছগাছালিতে জমে থাকছে শিশির। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিম্ন আয়ের মানুষের শীত নিবারণের একমাত্র অবলম্বন কাঁথা। এসব পরিবারের নারী সদস্যরা এখন কাজের ফাঁকে তাদের পুরোনো কাঁথা মেরামত আর ছেড়া শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে নতুন কাঁথা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি বাদশা সৈকত জানান, উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনের অধিকাংশ সময় সূর্যের দেখা মিলছে না। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
এ অবস্থায় কাজে বের হতে পারছে না শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষজন। গরম কাপড় না থাকায় ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকার চর ও দ্বীপচরের মানুষজন অসহনীয় ঠান্ডায় দিন যাপন করছে। বিশেষ করে, বিপাকে পড়েছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। মানুষের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছে গবাদিপশুও।
এদিকে, জেলা প্রশাসন থেকে শীতার্ত মানুষের জন্য এরই মধ্যে ৮ হাজার ৪০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার এ অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
– See more at: http://www.risingbd.com/detailsnews.php?nssl=81160#sthash.cYzRY07v.dpuf