গাজীপুর: রাত পোহালেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (গাসিক) ভোট গ্রহণ। শেষ মুহূর্তে সর্বত্রই চলছে ভোটের হিসাব-নিকাশ। কে হতে যাচ্ছেন গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মেয়র তা নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল রোববার ব্যস্ত সময় পার করেছেন গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ভোটারদের মন পেতে অলিগলিতে ঘুরেছেন তারা।
গাজীপুর মহানগরের ৫৭টি সাধারণ এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ জন ভোটার রয়েছেন । এর মধ্যে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৫ জন পুরুষ এবং ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন নারী ভোটার।
এই নির্বাচনে সাতজন মেয়র পদে ও ৮৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার মধ্যে একজন মেয়র, ৫৬ জন পুরুষ কাউন্সিলর ও ১৯ জন নারী কাউন্সিলর সংরক্ষিত আসনে বিজয়ী হবেন। একজন পুরুষ কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৫৬ পদে নির্বাচন হচ্ছে। গাসিকে মোট জনপ্রতিনিধি হলেন ৭৭জন।
নির্বাচন ঘিরে হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় চলছে ভোটের চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজধানী ঢাকার গাঁ-ঘেঁষে অবস্থিত দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল এই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন আলাদা তাৎপর্য বহন করে। গাজীপুরে ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান কাছাকাছি। এবারের গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বিগত সিটি নির্বাচনে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ খানকে পরাজিত করেন।
তবে এবার বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীর জন্য ভোটকেন্দ্রে বিএনপির ভোটারদের উপস্থিতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
অন্য দিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য দলের স্থানীয় সিনিয়র নেতাদের সাথে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটের বৈতরণী পার হওয়া মূল চ্যালেঞ্জ। মনোনয়ন নিয়ে দলে জুনিয়র ও সিনিয়র নেতাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং আছে তা নিরসন করে নেতাকর্মীদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা গেলে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভালো করা সম্ভব হবে। অবশ্য দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি, দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গাজীপুরের আওয়ামী লীগ সব ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে তাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করছে।
এ দিকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার আর গাজীপুরকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। অপর দিকে কাউন্সিলর প্রার্থীরা দিচ্ছেন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতোমধ্যে ২৯ প্লাটুন বিজিবিসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ, এপিবিএন ও আনসার বাহিনীর সদস্য গাজীপুরে অবস্থান নিয়েছেন।
বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগ : প্রচারণার শেষ দিন গতকাল রোববার ধানের শীষ প্রতীকে ২০ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি পুলিশি হয়রানির শিকার দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিতে ব্যস্ত সময় কাটান। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য অভিযোগ নিয়ে আসা নেতাকর্মীদের তিনি সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নিজ বাসভবনে এবং বেলা ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত গাজীপুর জেলা বিএনপি অফিসে সময় দেন। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের অভিযোগ শুনেন এবং পুলিশ ও সরকারি দলের সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের দিন কেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। পরে তিনি ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের টঙ্গী বাজারসহ আশপাশ এলাকায় গণসংযোগ করেন। এসব গণসংযোগে জেলা ও টঙ্গী থানা বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা তার সাথে ছিলেন। পথসভায় হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, নির্যাতিত মজলুম গণমানুষের বদ-দোয়ায় এবার নৌকা তলিয়ে যাবে। ন্যূনতম সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষের বিজয় সুনিশ্চিত বলেও তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
রোদ-বৃষ্টি, ঝড় ও সব বাধা উপেক্ষা করে মঙ্গলবার যথাসময়ে সবাইকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ধানের শীষে সিল মারার জন্য তিনি অনুরোধ জানান।
এ দিকে ধানের শীষের মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল এলাকা। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ধানের শীষের পক্ষে মিছিল বের হয়।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর গণসংযোগ : আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা) জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রচারের শেষ দিনে গণসংযোগ ও বৈঠক করে ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন। সকালে তিনি নগরীর সালনা এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করে দিনের কর্মসূচি শুরু করেন। পরে চান্দনা চৌরাস্তা, কোনাবাড়ি, বাসন, জয়দেবপুর, শিববাড়ি, গাছা, বোর্ডবাজার ও টঙ্গী মিলগেট এলাকায় গণসংযোগ করেন। দুপুরে তিনি ছয়দানা এলাকার নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
পথসভায় দেয়া বক্তব্যে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত নির্বাচনে এ সিটির মেয়র পদে বিএনপি নির্বাচিত হলেও গত ৫ বছরে এলাকার কোনো উন্নয়ন হয়নি।
এ সময় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: আজমত উল্লাহ খানসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর গণসংযোগ : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আলহাজ হাফেজ মাওলানা প্রিন্সিপাল নাসির উদ্দিনও গতকাল ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। সর্বশেষ প্রচারণার দিন তার সাথে ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব অধ্যাপক মাওলানা এ টি এম হেমায়েত উদ্দীন। এ ছাড়াও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আওয়াজ নিয়ে মাঠে ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ইসলামী সাংস্কৃতিক জোটের একটি টিম এবং জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন কলরবের পরিচালক বদরুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্য একটি টিম।
নিরাপত্তা : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। নেয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। সার্বিক নিরাপত্তায় বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১১ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবেন।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ইতোমধ্যে পুরো নির্বাচনী এলাকা নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিপুলসংখ্যক পুলিশ সাদা পোশাকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মহসিন রেজা জানান, বিজিবি সদস্যরা বুধবার পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালন করবেন। এর বাইরে আরো বিজিবি স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখান থেকে মোতায়েন করা হবে। এ সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডের প্রতি দু’টিতে এক প্লাটুন করে মোট ২৯ প্লাটুন বিজিবি দায়িত্ব পালন করবে এই নির্বাচনে। ২০ থেকে ৩০ জন বিজিবি সদস্য নিয়ে এ বাহিনীর এক একটি প্লাটুন গঠিত হয় বলে কর্মকর্তারা জানান।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জীব কুমার দেবনাথ জানান, ২৯ প্লাটুন বিজিবির মধ্যে কোনাবাড়ি ও কাশিমপুর এলাকায় ৭ প্লাটুন, টঙ্গী এলাকায় ১০ প্লাটুন এবং জয়দেবপুর, বাসন, চান্দনা চৌরাস্তা ও কাউলতিয়া এলাকায় ১২ প্লাটুন দায়িত্ব পালন করবে।