গাজীপুর: আর দু’দিন বাকি। মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ। গাজীপুর সিটির ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে দাবি করে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তবে অন্য প্রার্থী সুষ্ঠু ভোট নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। সুষ্ঠু ভোট শঙ্কা রয়েছে ভোটারদের মাঝেও। গাজীপুরের ৭ মেয়র প্রার্থীর ৫ জনই সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
শুধু মেয়র প্রার্থীই নয়। বিএনপি সমর্থকসহ বহু কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যেও একই সংশয় কাজ করছে। ফলে প্রচারণার আর মাত্র একদিন বাকি থাকলেও গতকাল পর্যন্ত গাজীপুরের নির্বাচনী প্রচারণা ছিল নিরুত্তাপ। যদিও বিভিন্ন ওয়ার্ডে গতকাল পোস্টার-লিফলেটের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন ও মাইকিং চোখে পড়েছে।
গাসিকের দ্বিতীয় নির্বাচনে এবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপি প্রার্থী মো. হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি প্রথম থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তার সংশয়ের কথা জানিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি করে আসছেন। গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রিটার্নিং অফিসারের কথা ও কাজে অনেক ফারাক।
বুধবার সিইসিসহ ৪ নির্বাচন কমিশনারসহ গাজীপুরে আসেন। তারা সবার সামনে অনেক কঠিন কথা বলেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও পরদিন থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সক্রিয় কর্মীদের ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সাদা ও ইউনিফর্ম পরিহিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা করছে। তারা নিরপেক্ষ আচরণ করছেন না। আমাদের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে অন্য জেলার থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে। আমরা এতকিছু সহ্য করছি। মোকাবিলা করছি। ভোটের দিন কেন্দ্র দখল ও জালভোট দেয়া হলে জনগণ তা প্রতিহত করবে। পুলিশের সহযোগিতায় তা করা হতে পারে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) দলীয় প্রতীক কাস্তে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কাজী মো. রুহুল আমিন। তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, বুর্জোয়া রাজনীতির বড় অপকৌশলের অংশ হিসেবে এই নির্বাচন পেছানো হয়েছে। হাড় একবার ভাঙলে জোড়া লাগানো কঠিন। অন্য প্রার্থীরা নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগে প্রথম দফায় তাদের শক্তি ও সঞ্চয় খরচ করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীরের টাকা আছে। তিনি টাকা দিয়ে সব চালিয়ে নিচ্ছেন। আগের নির্বাচনী উৎসব এখন আর নেই। পুলিশের ভীতিও কাজ করছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভোটারের উপস্থিতি কম হবে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করতে পারছি না।
ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী ফজলুর রহমানের দলীয় প্রতীক মিনার। নগরীর কিছু কিছু এলাকায় তার পোস্টার শোভা পাচ্ছে। এ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে কোনো গোলযোগ না হওয়ায় তিনি স্বস্থি প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তফশিল ঘোষণার ৮২ দিনে গোলযোগ হয়নি। তবে নির্বাচন স্থগিত করায় এবং অনেক লোক ঈদের ছুটিতে গাজীপুর ছাড়ায় নির্বাচন আর জমেনি। আমরা ভোটারদের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা সেই প্রশ্ন তাদের মধ্যে রয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরবর্তী কেন্দ্রগুলোতে ঝুঁকি রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় থাকলেও আমরা যেহেতু এখন পর্যন্ত তার প্রকাশ দেখিনি তাই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা রাখি।
ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মো. নাসির উদ্দিন। তার প্রতীক হাতপাখা। সঠিকভাবে ভোট দিতে পারবো কিনা সে সন্দেহ আছে। ভোটারদের মধ্যে সেই সন্দেহ আরো বেশি। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমার আশঙ্কার কথা গত বুধবার আমি সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সামনে প্রকাশ করেছি। এখন আমরা একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ নির্বাচন চাই। তবু আমরা আশাবাদী থাকতে চাই। এখন নির্বাচন জমছে না। তার কারণ কী? এর দায় কার? সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।
নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী মো. জালাল উদ্দিন। মেয়র পদে তার প্রতীক মোমবাতি। তিনি নির্বাচন নিয়ে শুধু শঙ্কিতই নন। সোচ্চারও। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই নির্বাচন পেছানো হয়েছে। এখন মাঠে ভোটের আমেজ নেই। ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে। ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে সেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাবৃন্দ সবার সঙ্গে সমান আচরণ করছে না। সরকারি দল নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে তা দেখেও না দেখার ভান করছে। আর অন্যরা আচরণবিধি ভঙ্গ করলে জরিমানা আদায় ও শাস্তি দেয়া হচ্ছে। গতবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গাজীপুর আসার পর নির্বাচন বন্ধ হয়েছে। এবারও তারা আসতে শুরু করেছে। এতে আমরা আরো কিছু ঘটার আশঙ্কা করছি। ব্যাপক নেতাকর্মী এসে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে পারে।
তবে ওই পাঁচ প্রার্থীর সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে থাকলেও একেবারে নির্ভার আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ। অপর প্রার্থী ও ভোটারদের সংশয় নাকচ করে দিয়ে তারা দু’জনই নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠুভাবে হবে বলে জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সরকারকে বিব্রত করার জন্য ও প্রশ্নের মুখে ফেলার জন্য বিএনপি প্রার্থী তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শে এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। গাজীপুরে অতীতের সবগুলো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এবারের নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমেদ বলেন, এখন নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। তবে অনেক ভোটার এখনও এলাকায় না আসায় ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। প্রশাসন সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও মিডিয়া যদি নিরপেক্ষ থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আর বিএনপি’র নেতাকর্মী যাদের বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াও মামলা আছে তাদেরকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে নির্বাচনের মাঠে সুবিধা দেয়ার জন্য প্রার্থী হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষ অনেক কিছু ভাবতে পারে। নির্বাচনী মাঠে দেয়াল ঘড়ি প্রতীকের পোস্টার তেমন চোখে পড়ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃষ্টিতে পোস্টার ছিঁড়ে গেছে। তাই এখন লিফলেট ও স্টিকারের দিকে ঝুঁকেছি।
ওদিকে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকেও গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন বলে জানান। ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মো. খায়রুল আলম বলেন, আমার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বহুবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন ঘরে ঘরে গিয়ে নেতাকর্মীদের নাম তালিকা হচ্ছে। এতে ভীতি ছড়াচ্ছে। তাতে ২৬শে জুন নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু হবে। তবে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী নিজেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী দাবি করে বলেন, এই ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপক গণসংযোগ না হলেও আজ আমার বড় গণসংযোগ হবে। নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবেই হবে।
এদিকে ঈদের ছুটি শেষে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা গাজীপুরে ফিরতে শুরু করেছে চাকরিজীবী ভোটাররা। আজ শনিবার থেকেই মূলত অধিকাংশ পোশাক কারখানা খুলছে। গতকাল টঙ্গী বাস স্টেশন ও চান্দনা চৌরাস্তায় সকাল ও দুপুরের দিকে চাকরিজীবীদের ফিরতে দেখা গেছে। কিন্তু তাদের অনেকে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তাদের আশঙ্কা কথা জানিয়েছেন। শফিক উদ্দিন কোলে সন্তান ও সঙ্গে স্ত্রী সাফিয়াকে নিয়ে টঙ্গী আসেন। তারা দু’জনই টঙ্গীতে ভোটার। শফিক বলেন, খুলনার মতো ভোটে জালিয়াতি হবে বলে শোনা যাচ্ছে। সেইদিন যেহেতু অফিস বন্ধ। তাই ভোট দিতে যাব। কোনো সমস্যা হলে চলে আসবো।
গাজীপুর চৌরাস্তায় কথা হয়, লাকী নামে অপর এক পোশাক কর্মীর সঙ্গে। তিনি এখানে ভোটার হলেও তার স্বামী আবু সালেহ বরিশালে ভোটার। লাকী বলেন, আমার ভোট আমি দেবো। যাকে খুশি তাকে দেবো। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে জয়দেবপুরে কথা হয় মুদি দোকানদার বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে। এখন তো শুধু পোস্টারই দেখি। আর তো কিছু দেখি না। ভোট কেমন হবে কী জানি। ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, আমাকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আমার প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার জন্য হুমকি দেয়। না শুনলে গ্রেপ্তারের ভয়ও দেখানো হয়। নির্বাচনের প্রচারণা থেকে সরে যেতে বলেছে। এ অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কী না সেই উল্টো প্রশ্ন করে বসেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, খুলনার পর সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এখানে আশঙ্কাটা বেড়েছে। গাজীপুরে তাই হয় কিনা। প্রার্থীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আছে। তবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যদি সরকার দলীয় নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে ভালো কিছু হবে না।