ঢাকা: গ্রীষ্মে থাকবে কাঠফাটা রোদ। ছায়ায় বসে হাঁ করে দম নেবে কাক। জিব বের করে হাঁপাতে থাকবে কুকুর। শ্রমজীবীর গা বেয়ে দরদরিয়ে নামবে ঘাম। মাথার ওপর বনবন করে ফ্যান ঘুরলেও স্বস্তি মিলবে না। কিন্তু এসব কিছুই ঘটছে না। এবারের গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ঘন ঘন অঝোর বৃষ্টি। যেন বর্ষার ভারী মেঘ এসে সওয়ার হয়েছে গ্রীষ্মের রুদ্র মেঘে।
প্রকৃতি কেন তার চিরাচরিত ধারা থেকে সরে গেল এবার? তবে কি এবারের বর্ষা আরও বেশি—আকাশ-ঢালা বৃষ্টি নিয়ে আসবে? বন্যায় ভাসবে দেশ?
গত ৩০ বছরের বৃষ্টিপাতের গড় হিসাব করে স্বাভাবিক বৃষ্টির মাত্রা নির্ণয় করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই অনুযায়ী গত ১৫ মাসে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বেশি বৃষ্টির এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের মার্চে। ওই সময় স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়। মার্চে এই বেসামাল বৃষ্টি হয়েছিল দেশের উত্তর-পূর্বের জেলাগুলোর হাওর অঞ্চলে। এর ফলে দেশের হাওরসহ নিম্নাঞ্চলের বোরো আবাদের ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অতিবৃষ্টির কারণে ওই সময় কৃষকদের ৭২০ কোটি টাকার কৃষিসম্পদের ক্ষতি হয়। পরের মাস এপ্রিলেও স্বাভাবিকের চেয়ে ১০৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির ধারাবাহিকতা থেকে যায়।
কিন্তু বর্ষাকাল আসার আগে ২০১৭ সালের মে মাসে বৃষ্টির মেজাজ ঘুরে যায়। ৩১ দিনের মে মাসের পুরোটাই ছিল প্রায় বৃষ্টিহীন। শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল ২৯ মে উপকূলে চলে আসে ‘মোরা’। এরপরও চলে কয়েক দিন টানা বৃষ্টি। তবুও স্বাভাবিকের চেয়ে এর পরিমাণটি ছিল ১৬ দশমিক ১ শতাংশ বৃষ্টি কম। ‘মোরা’র কারণে কিছু দেরি করেই বাংলাদেশের ওপর এসেছিল মৌসুমি বায়ু। কিন্তু বৃষ্টির দাপট কমেনি জুন মাসেও। এই মাসে বাংলাদেশে বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল ৩৪৭ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টি হয়েছিল ৪৫৭ মিলিমিটার, অর্থাৎ পূর্বাভাসের চেয়ে গড়ে ১১০ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গত বছর জুনে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল।
তবে মধ্য বর্ষায় মৌসুমি বায়ু আরও শক্তিশালী রূপ নেয় জুলাইয়ে। এ সময় বৃষ্টি হয় ৩২ শতাংশ বেশি। আগস্ট মাসেও চলতে থাকে অতিবৃষ্টি। এতে এই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়। জুলাই ও আগস্টের অতিবৃষ্টিতে দুই দফায় বন্যাও হয় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে। তবে বর্ষাকালের বৃষ্টির দাপট শরৎকালেও বজায় ছিল। এর প্রমাণ মেলে সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অক্টোবর মাসে ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হওয়ায়।
অতিবৃষ্টির দাপটে টান পড়ে হেমন্তকালে। এই মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও বাস্তবে হয়েছিল ১১ দশমিক ১ মিলিমিটার। এটি স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ কম। কিন্তু শীতের সময় ডিসেম্বরের বেশ কয়েকটি দিনও বর্ষার মতো রূপ নেয়। নিম্নচাপের প্রভাবে ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিন ঝরে বিরামহীন বৃষ্টি। তাই স্বাভাবিক বৃষ্টি ১০ মিলিমিটারের আভাস থাকলেও ডিসেম্বরে বৃষ্টি হয় ৪৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এটি ৩৮৫ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
মধ্য ডিসেম্বরের পর বাড়তে থাকে শীতের প্রকোপ। এ বছরের জানুয়ারি মাসে শুরু হয় কয়েক দফা শৈত্যপ্রবাহ। ৮ জানুয়ারি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শৈত্যপ্রবাহের কারণে জানুয়ারিতে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়। মার্চের প্রথম দিকে শুষ্কভাব রইলেও ২৯ থেকে ৩১ মার্চ তিন দিন ভারী বৃষ্টি হয়। এ সময় থেকে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে থাকে। তবুও মার্চে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়।
এপ্রিল আর মে মাসে অনবরত কালবৈশাখী ছোবল হানে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে।
২০১৭ সালের মতো এবারও অতিবৃষ্টি হয় এপ্রিলে। গ্রীষ্মকালের ছিটেফোঁটা ছিল না এই মাসে। দেশের উষ্ণতম মাস হিসেবে পরিচিত এপ্রিলে ছিল না দাবদাহ বা ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালি বায়ুপ্রবাহের সংযোগ এবং বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে জলীয় বাষ্পের জোগান বৃদ্ধির কারণে প্রথম দফায় ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত বিজলি চমকিয়ে ঝোড়ো বৃষ্টি হয়। এমনভাবে বিজলিচমকে ঝোড়ো বৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় দফায় ছয় দিন—১৭ থেকে ২২ এপ্রিল, তৃতীয় দফায় ২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল তিন দিন এবং সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল। ১২৭ মিলিমিটারের পরিবর্তে এপ্রিলে বৃষ্টি হয় ১৭৩ মিলিমিটার। এটি ছিল ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। একই অবস্থা মে মাসে ছিল। এই বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল ২৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু ৩১৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে মে মাসে, যা ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণ
বাংলাদেশের কালবৈশাখী বেশি হয় মার্চ থেকে মে মাসে। সাধারণত এ সময় উত্তরের রাজশাহী অঞ্চলে কালবৈশাখী বয়ে যাওয়া শুরু করে। বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ হয়ে সিলেটের দিকে কালবৈশাখী বয়ে যায়। কিন্তু ২০১৮ সালে কালবৈশাখী বয়ে যাওয়ার গতিপথ বদলে গেছে বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদেরা। তাঁদের মতে, এবার মধ্যাঞ্চল থেকে ঝোড়ো হাওয়া পথ পরিবর্তন করে ঢাকা জেলার দিকে চলে আসছে। এ কারণে রাজধানী ও এর আশপাশের অঞ্চলে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
প্রকৃতির এই আচরণ স্বাভাবিক, নাকি অস্বাভাবিক—তা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার বায়ুর আর্দ্রতার তারতম্যের রেখার পর মেঘমালা প্রচুর পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। এ কারণে এপ্রিল মাসে দেশের উত্তর থেকে পূর্বাঞ্চলে কালবৈশাখীর সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টি বেশি হতে দেখা গেছে। এই ধারাবাহিকতা মে মাসেও ছিল। আর জুন মাসের ১ তারিখে মৌসুমি বায়ু দেশের ওপর চলে আসায় বৃষ্টির রেশ বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। টানা বৃষ্টি হলেও বন্যাও হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রাক-বর্ষাকালে সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ জেলায় অতিবৃষ্টি হয়েছিল। এ সময় প্রচুর বৃষ্টি হয় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও। এর প্রভাবে আমাদের হাওর অঞ্চলে বোরো ধান নষ্ট ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু এ বছর তেমনটি ঘটেনি। হাওরে ধান ভালো হয়েছে। গত ১৫ বছরের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এবার প্রাক-বর্ষাকাল একটু ব্যতিক্রম। এটি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ চৌধুরীর একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে আরিফুজ্জামান বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরের পার্থক্যের প্রভাব বাংলাদেশসহ আশপাশের অঞ্চলে পড়ে। এ অঞ্চলে এল নিনোর কারণে গরম বেশি পড়ে। আবার লা নিনার জন্য বৃষ্টি হয়। দুই-তিন বছর পরপর এই পরিবর্তন হয়ে থাকে। এ কারণে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এল নিনোর জন্য প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে কালবৈশাখীর সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এটি লা নিনার কারণে হচ্ছে বলেই মনে করেন তিনি।
জুনের শেষ দিকে বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, উজান বা ভারতে অতিবৃষ্টি হলে বাংলাদেশে বন্যা হয়। এবার কিছুটা আগে ১ জুন থেকে মৌসুমি বায়ুর দেশের ওপরে বিস্তার ঘটেছে। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃষ্টি স্বাভাবিক মাত্রায় এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। মৌসুমি বায়ু ভারতের এসব অঞ্চলে বিস্তৃত হলে বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। তাহলে জুনের মধ্যভাগ থেকে শেষের দিকে যমুনা অববাহিকায় বন্যা হতে পারে। এর প্রভাব তখন বাংলাদেশে পড়বে। অনেক অঞ্চলে দেখা দেবে বন্যা।
ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস অবশ্য এরই মধ্যে দিয়ে রেখেছে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। জুনের প্রথম সপ্তাহে ভারতের আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যে ভারী ও বজ্রবৃষ্টি হতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। এরপর এসব রাজ্য ছাড়াও ৭ ও ৮ জুন পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে ভারী বৃষ্টি হবে বলে জানায় ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বৃষ্টির এই আচরণকে এখনই অস্বাভাবিক মনে করছেন না আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালের মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছিল। এ বছর মে মাসে কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে কম। তাই দেখা যায় এক বছর বেশি বৃষ্টি হয়, আবার দেখা যায় পরের বছর বৃষ্টির পরিমাণ কমে যায়। কখনো কখনো অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়ে যায়। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট তিন ঘণ্টায় ঢাকায় ১২৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। যদি একটানা কয়েক বছর এভাবে বৃষ্টিপাত হতে থাকে, তাহলে বলা যেতে পারে—এটি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন প্রভাব পড়ছে।