ঢাকা: কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হকের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ঘটনার অডিও ক্লিপ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সব দলমতের মানুষ শোক প্রকাশ করছেন এ ঘটনায়।
একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রকাশ পাচ্ছে নিহত একরামের স্ত্রী ও দুই মেয়ের প্রতি। স্বজনের মৃত্যুর মুহূর্তটি সরাসরি উপলব্ধি করার মতো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া এই পরিবারের মতো আর কেউ যাতে এমন অবস্থায় না পড়ে তারও প্রার্থনা করেছেন কেউ কেউ। ঘটনার পর থেকে কক্সবাজারের সব শ্রেণি-পেশা ও দলের মানুষের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসছে। বিশেষ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন।
কেউ কেউ আবেগ-আপ্লুত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ হোসাইন তানিম লিখেছেন, একটি অডিও ক্লিপই যথেষ্ট সারা দেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদেরকে আহত করার। অডিও একটি, প্রশ্ন অনেক…, প্রশাসনে কি সবাই আওয়ামী লীগ?
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নুরুল আজিম কনক লিখেছেন, ‘জানি না এ রক্তক্ষরণ কখন বন্ধ হবে। ফেসবুক খুলতেই মনের ভেতরে সমস্ত অবৈধ অন্যায় অত্যাচার- নিজের বিবেককে বাংলা গালিগালাজ করা শুরু করে। শহীদ একরাম ওপারে…। নাছির উদ্দিন হায়দার নামের একজন লিখেছেন, ‘বাবাকে গুলি করার শব্দ শুনলো মেয়ে, স্বামীকে হত্যার শব্দ শুনলো স্ত্রী-নৃশংস! মর্মন্তুদ!’
অ্যাডভোকেট খালেদুল কবির লিখেছেন, আর নয় ক্রসফায়ার, চাই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ’।
মাহাবুবুল আলম সেলিম নামের একজন কাউন্সিলর একরামকে বাংলার নবাব উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘বাংলার নবাব। বারবার ইচ্ছে করছে তোমার কবরে গিয়ে সালাম জানাতে। আজ তুমি মরে প্রমাণ করলে সরকার ভুল পথে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমার মৃত্যু শহীদের মর্যাদায় হোক এ দোয়া করি’।
ম. ন. আবছার নামের একজন ব্যবসায়ী লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দুই আদুরে কন্যা, একরামের দুই আদুরে কন্যা, আর আমার দুই আদুরে কন্যা…, তোমরা দুই কন্যার পিতাদের একটাই দীর্ঘশ্বাস, পিতা- যাকেই বিশ্বাস করে সেই করে সর্বনাশ। বঙ্গবন্ধুকে শেষ করেছে সন্তানসম বিপথগামী সেনারা। একরামের প্রাণ কেড়ে নিলো বন্ধুবেশী চক্রান্তকারীরা। আমি আতঙ্কিত চারপাশে আজ মৃত্যু খুঁজে বেড়ায়। কন্যার পিতাদের জন্য এ পৃথিবী কি নিরাপদ নয়?
কাউন্সিলর একরামের অসম্পূর্ণ একটি বাড়ির ছবি দিয়ে ম. ন. আবছার আরেকটি পোস্টে লিখেছেন, ‘এটা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ইয়াবা সম্রাট (?) একরামুল হক কমিশনারের অসমপূর্ণ বাড়ি। ৭ বছর ধরে এভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। উনি এতবড় ইয়াবা সম্রাট হয়েও ৭ বছর ধরে বাড়িটিই পরিপূর্ণ করতে পারেননি। অথচ উনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের ১২ বছরের সভাপতি ছিলেন ও টেকনাফ পৌরসভার তিন তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর। দেশের আনাচে কানাচে উনার কোনো স্থাবর-অস্থাবর সমপত্তি আছে কিনা কেউ জানে না। শহরে-বন্দরে কোনো আলিশান ফ্ল্যাট আছে কিনা তাও কেউ জানে না। কোনো নামিদামি গাড়িও নেই। রিকশাচালক থেকে হঠাৎ কোটিপতি হওয়া লোকটিও নিজের ছেলেমেয়েকে চট্টগ্রাম-ঢাকা শহরে নামিদামি স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে।
অথচ জন্মগতভাবে খানদানি ও আধুনিক ঘরের সন্তান একরামুল হক নিজের মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন টেকনাফের বিজিবি স্কুলে। ক্রসফায়ারড হওয়ার আগেও নিজের দু’মেয়ের স্কুলের খরচ জোগাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন! নিশ্চয় উনার সততা, জনপ্রিয়তা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই এবং সম্ভবত এটাই উনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সাদিয়া আফরিন নামের একজন লিখেছেন, অডিওটি শোনার পর থেকে নিঃস্তব্ধ। কারণ মেয়েটির হ্যালো…হ্যালো…বলার পর যা ঘটলো তা শুনে ওই রাত, পরের রাত এবং আজকের রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাতে গেলেই কানে বাজে ওই লাইনের প্রতিটি প্রতিধ্বনি।
সাইফুল সাইফ নামের একজন লিখেছেন, ‘বেশ একটা প্রচলিত শব্দ, ‘উপরের অর্ডার’! কে সে বা কারা জানতে বড় ইচ্ছে করে! পরকালের বিচারে উপর বলতে যখন আর কিছু থাকবে না, সেই দিন হয়তো দেখার সুযোগ হবে! হে আল্লাহ নিরপরাধ মানুষদের রক্ষা করার মালিক তুমি!
শাহিদ মোস্তফা নামের একজন লিখেছেন, ‘অডিওটা শুনে চোখের অশ্রু ধরে রাখা যাচ্ছে না। হে আল্লাহ একরাম ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে হলেও এ দেশটা মাদক মুক্ত হোক। শান্তিতে থাকুন জননেতা একরাম ভাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন, মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে দু’সন্তানের পিতা একরামুলকে। অডিও টেপ পাওয়া গেছে বলে আমরা জেনেছি এই পাশবিক খুনের বিবরণ। বন্দুকযুদ্ধের নামে না জানি সবার অলক্ষ্যে এমন কতো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ! সব জঘন্যতম অপরাধের বিচার হয় না এদেশে। হবেও না হয়তো কখনো। অসহায়ের মতো আমিও আজকাল ভাবি: আল্লাহর গজব পড়ে না কেন এসব খুনির ওপর!
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, একরামুল হত্যায় যদি আপনি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, এই হত্যা যদি আপনি সমর্থন না করেন তা হলে বুকে হাত রাখুন, বুকে হাত রেখে আপনার প্রিয়জনের নামে কসম খেয়ে বলুন যদি এই অডিও আপনি না শুনতেন তা হলেও এই হত্যার বিরুদ্ধে আপনি বলতেন কিনা; বলুন একরামুল যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতা না হতেন তা হলেও আপনি নির্দ্বিধায় এর বিরোধিতা করতেন কিনা। যদি একরামুলের কন্যার কান্না আপনাকে সত্যি স্পর্শ করে থাকে তবে এইভাবে আর যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের সন্তানদের আর্তনাদ কল্পনা করুন। অডিও রেকর্ড নেই বলে তাদের বুকফাটা কান্না এরচেয়ে কম হৃদয়বিদারক ছিল না। যদি এই হত্যার বিচার চান তাহলে বলুন এখনই এই হত্যালীলা বন্ধ হোক, একরামুলের হত্যার বিচার চাইবার এটাই হচ্ছে পূর্বশর্ত। আপনি যদি সেটা বলতে না পারেন, আপনি যদি না বলতে পারেন যে আপনি সব বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে তা হলে এই হত্যার বিরোধিতা করার কোনো নৈতিক অধিকার আপনার নেই। আপনি যদি অতীতে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরোধিতা না করে থাকেন, এই হত্যার দায় আপনারও; আজকে যদি কেবল এই হত্যার ‘বিচার’ দাবি করেন তবে আপনি বাকি প্রত্যেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধতা দিলেন, সেইসব হত্যার দায় আপনারও। এখন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন?
সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন, কমিশনার একরামুলকে চিনি না, জানি না। তার স্ত্রী-কন্যাদের চেনার জানার কোনো কারণ নেই। একরামুলের স্ত্রীর সরবরাহ করা অডিও ক্লিপের হাহাকার, ভেতরটা ওলটপালট করে দিচ্ছে। আপনি, হ্যাঁ আপনাকে বলছি। হয়তো অডিও ক্লিপটি শুনেছেন বা শোনার চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিক থাকতে পেরেছেন? ভয়-আতঙ্ক-ক্ষুব্ধতা-ক্ষিপ্ততা, আপনাকে জাপটে ধরেনি? নিশ্চয় ধরেছে, যদি আপনি মোটামুটি বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হয়ে থাকেন।
সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ লিখেছেন, একটা নির্ঘুম কঠিন রাত পার করলাম। ঘুম আসে আবার ভাঙে। ইকরামের পরিবারের অডিওর শব্দ বার বার কানে আসে। সৃষ্টিকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, তুমি এ কেমন রাষ্ট্র দিলা? যে রাষ্ট্রে শুধু একটি মানুষ নয়, একটি পরিবারও নিষ্ঠুরভাবে খুন হলো? কি অপরাধ একরামের কন্যার? আর তার স্ত্রীর? এমন রাষ্ট্রের জন্যই কি আমরা ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম? রাষ্ট্র কারো জন্ম দিতে পারে না। তাই রাষ্ট্র কারো জীবনও কেড়ে নিতে পারে না। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মাদকের নেশা বন্ধ করতে খুনের নেশায় মত্ত হওয়া রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট একেএম ওয়াহিদুজ্জামান লিখেছেন, আওয়ামী লীগ নেতা একরামকে হত্যার লাইভ অডিও শুনে অনেকে আবেগে আপ্লুত হবার পাশাপাশি এই আশা পোষণ করছেন যে, এর বিচার হবে! এমন আশাবাদীদের জন্য করুণা হচ্ছে। স্মরণ করতে পারেন ২০১১ সালে নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে হত্যার লাইভ ভিডিও ছিল। সেই ভিডিও থেকে খুনিদের শনাক্ত করাও হয়েছিল। আজও বিচার হয়নি। খুনিরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন একরামকে গণমাধ্যমই মাদক ব্যবসায়ী বানিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, বাবা কন্যার অডিও আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। কাঠগড়ায় র্যাব, সত্য মিথ্যা যাচাই হয়তো পরে হবে। শারীরিক ভাবে একরাম নাই হয়ে গেছে সপ্তাহখানেক। অভিযোগ ছিল মাদক ব্যবসার। কিন্তু এই একরামকে সামাজিকভাবে নাই করা হয়েছে আরো পাঁচ বছর আগে। তাকে মাদক সম্রাট বানিয়েছিলো আমাদের মিডিয়া। দিনের পর দিন রিপোর্ট বানানো হয়েছে একরামকে নিয়ে। সামাজিকভাবে তাকে মারা হয়েছে অনেক আগেই। একরামের অপরাধ ছিল একটাই, সে টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিল। এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে অনেককে বানানো হচ্ছে মাদক সম্রাট, তথ্য প্রমাণ ছাড়া সামাজিকভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে অনেককেই। মিডিয়ার এই অসুস্থ প্রক্রিয়া বন্ধ হোক… তাহলে আমাদের অনেকের কান্নারও অবসান ঘটবে।
সাংবাদিক নেতা পুলক ঘটক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, কোনো বাহিনীকে মানুষ খুনের দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। যে অপকর্ম জামায়াত-বিএনপি সরকার করেছে সেই কর্ম যদি আওয়ামী লীগ সরকারও করে তাহলে তফাৎ রইলো কোথায়? বিচার ছাড়া কাউকে দণ্ড দেয়া যাবে না। একরামুল ও সমর বাবুর সন্তানদের বেদনা অধিকর্তাদের বুকে বাজুক। ক্ষমতাধর নেকড়ে নয়, আসুন আমরা মানুষ হই।