জিয়াউর রহমান— এক দেশজোড়া- জগজ্জোড়া নাম। এ নাম একজন রাষ্ট্রপতির।
এ নাম একজন রাষ্ট্রনায়কের— মহান তিনি জীবনাদর্শে, চিন্তা-চেতনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতায়। এ নাম একজন শক্তিধর ব্যক্তিত্বের— এক ক্যারিশমাসমৃদ্ধ মহান সমর-নায়কের। এ নাম জাতির এক কঠিন দুঃসময়ের চরম সংকটে মাতৃমুক্তিপণ করা এক সৈনিকের। এ নাম স্বাধীনতাযুদ্ধে এক বিউগল ব্লোয়ারের— জাতিকে অস্ত্রহাতে সশস্ত্র যুদ্ধে আহ্বানকারী এক রণডঙ্কা বাদকের। জিয়া একটা স্ফুলিঙ্গের নাম; যা সারা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ পেইরিতে দাউ দাউ করে যুদ্ধের দাবানল জ্বালিয়েছিল।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাতে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার অপারেশন সার্চলাইট নামে পোড়ামাটির নীতি জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা কর (scorch earth policy, burn all, kill all, loot all) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশজুড়ে গণহত্যা শুরু করে তখনই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সহযোদ্ধাদের বললেন, তোমাদের সিদ্ধান্ত তোমাদের কাছে কিন্তু আমি আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। To be or not to be দোলাচলে আর নয়। I revolt। আমি বিদ্রোহ করলাম।
সহযোদ্ধারা, রেজিমেন্টের সৈনিকরা সবাই তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করে সমস্বরে বলে উঠল আই নয় উই। we revolt। আমরা বিদ্রোহ করলাম। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া কর্ণফুলী নদী অতিক্রম করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখলে নিয়ে প্রথমে নিজ নামে, পরে তা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পুনরুচ্চারণ করেন। তিনি দেশবাসীকে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানান। ইথারে ভেসে আসা তাঁর কণ্ঠের ঘোষণা পথে-প্রান্তরে নগরে-বন্দরে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশের প্রতি কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। বাংলাদেশের (তখন) সাড়ে সাত কোটি মানুষ সবাই শুনেছিল। শুনেছিল বিশ্ববাসীও।
চট্টগ্রামে অবস্থানরত মেজর জিয়ার রেডিও ঘোষণা ও তাঁর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, সব সেনাছাউনির বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোয় ও অন্য বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করে। অনুপ্রাণিত করে। তারা অন্ধকারে দিশা পায়। ভ্রান্তি কাটিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ করে। ঢাকার অদূরবর্তী জয়দেবপুরে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল, কুমিল্লা সেনাছাউনিতে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর পরের ইতিহাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের কঠিন ইতিহাস। রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার এক অমর আখ্যান। আর এ অগ্নি-আখ্যানের অগ্নিপুরুষ, অগ্নিপথের অগ্রযাত্রী মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে আমরা জিয়াকে দেখেছি ক্লান্তিহীন যুদ্ধরত, সেক্টর অধিনায়করূপে; ফোর্স (ব্রিগেড) হিসেবে প্রথম গঠিত জেড ফোর্স কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা দুর্দমনীয়, দুঃসাহসী ও অতুলনীয়। তাঁর সাহস, শৌর্য-বীর্য, রণদক্ষতা অধিনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব গোটা যুদ্ধে রণাঙ্গনের প্রতিটি সৈনিককে অনুপ্রাণিত করেছিল, সাহস জুগিয়েছিল, মনোবল অটুট রেখেছিল, যুদ্ধের জয় নিশ্চিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র। জিয়া তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন। গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি চাকরিরত পিতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে থেকেছেন, সেখানে পড়াশোনা করেছেন। তিনি সেখান থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের যোজন দূরত্বের নগ্নরূপ তিনি দেখেছেন। জাতীয় বঞ্চনার সঙ্গে সেনাবাহিনীতেও তিনি বঞ্চনা দেখেছেন তার শিকার হয়েছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বৈষম্যের এক বর্ণবাদী রূপ। বাঙালির প্রতি জাতিগতভাবে তাদের একটা অবহেলা, অবজ্ঞা ও চাপা ঘৃণা বাঙালিরা তখন গভীরভাবে অনুভব করেছে। জিয়া উপলব্ধি করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তান কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে প্রতিটি ক্ষেত্রে মার খাচ্ছে। অবহেলা আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছে— এর একমাত্র কারণ, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের চিরায়ত চর্চাহীনতা, গণতন্ত্রের দীর্ঘ মহাশূন্যতা। আর এটা পাকিস্তানকে ঠেলে দিয়েছে স্বৈরশাসনের দিকে। সেনা কর্তৃত্ব শিকড় গেড়ে বসেছে। একটা পাঞ্জাবি সুভেনিজম দানবের আকৃতি ধারণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে সামরিক বৈষম্যও প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে।
সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহাই জিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, বাঙালি এক পৃথক জাতিসত্তা এবং তা অনেক সমৃদ্ধ ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। গণতন্ত্রের পথ ধরে বাঙালি জাতি তার স্বীয় আসন নির্মাণ করে নেবে বিশ্বসভায়। তার সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে নতুন উচ্চতায় উত্তরণ ঘটাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে আনবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জাতিকে করবে মহাসমৃদ্ধিশালী।
আমরা গণতন্ত্রের প্রতি জিয়ার অবিচল বিশ্বাসকে প্রতিফলিত হতে দেখেছি বার বার। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের লগ্নে জ্যেষ্ঠতম হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেনাপ্রধানের নিযুক্তিতে তাঁর কনিষ্ঠ দ্বারা পদোন্নতিতে অতিক্রান্ত হন। জিয়ার নিশ্চয়ই এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। নিশ্চয়ই তা তাঁর আত্মমর্যাদা, সৈনিকের আত্মশ্লাঘায় আঘাত হেনেছিল। অনন্য এ অনুভূতি একমাত্র একজন সৈনিকই কেবল উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু জিয়া সেনাশৃঙ্খলা কখনো ভঙ্গ করেননি। তাঁর সৈনিকোচিত আচরণে কোথাও কখনো তা এতটুকুও প্রতিফলিত হয়নি। তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখে সেনা উপ-প্রধানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ইসলামের ইতিহাসের ঊষালগ্নে এমনি একটি দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ছে। অপরাজেয় সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ কোনো যুদ্ধে কখনো পরাজিত হননি। খলিফা হজরত ওমর হয়তোবা খালিদের সৈনিকোচিত চরিত্রের অগ্নিপরীক্ষা নিতেই তাঁকে সেনাপতির পদ থেকে একজন সাধারণ সৈনিকের কাতারে নেমে আসার নির্দেশ দেন। জেনারেল খালিদ বিন ওয়ালিদ সে আদেশ শিরোধার্য করে সাধারণ সৈনিক হয়ে অনেক যুদ্ধ অভিযানে অংশ নিয়েছেন। খলিফা হজরত ওমর অবাক বিস্ময়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্ণ সম্মানে সেনাপতির দায়িত্বে ফিরিয়ে আনেন।
১৫ আগস্ট (১৯৭৫) জাতীয় ইতিহাসের মসিলিপ্ত এক মহাকলঙ্কিত দিন। সেদিন মধ্যরাতে এক হৃদয়বিদারক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতিসত্তার উন্মেষক স্বাধীনতার মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রক্তমাখা হাতে তাঁরই দলের এক শীর্ষ নেতা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেন আকস্মিক ও অতর্কিতে। সামরিক শাসন জারি হয়। জারি করেন কোনো সামরিক ব্যক্তিত্ব নয়, সোজাসাপ্টা কথায় ক্ষমতালিপ্সু ষড়যন্ত্রকারী দলীয় রাজনৈতিক চক্র। গভীর এক অনিশ্চয়তা, এক মহাঅস্থিরতা নেমে আসে সারা দেশে। স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীতেও এর অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়ে।
আমরা দেখেছি ১৯৭৫-এর নভেম্বরের শুরুর দিনগুলোয় দেশে এক চরম নৈরাজ্য, নৈরাশ্য, এক সীমাহীন হতাশা। অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা গোটা জাতিকে সংকটাপন্ন করে তোলে। একটা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। দেশ তখন সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন। কোনো সরকার নেই। প্রশাসন নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে। হারিয়ে গেছে। এরই পটভূমিকায় ৭ নভেম্বরে গোটা দেশজুড়ে ঘটে সৈনিক-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান। জাতির ভাগ্যাকাশে এ ছিল কঠিন যুগসন্ধিক্ষণ— এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতার ভাষায়—
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
… না নৌকাডুবি হয়নি। জিয়া অদম্য সাহসের সঙ্গে বজ্রকঠিন শক্ত হাতে সেই উত্তাল সমুদ্রে নোঙরবিচ্ছিন্ন ডুবুডুবু তরীটির হাল ধরেন।
দেশ তখন সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন। কোনো সরকার নেই, প্রশাসন নেই, যোগাযোগ নেই। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গোটা বাংলাদেশ যেন গোটা বিশ্ব থেকে কোথায় ছিটকে পড়েছে, হারিয়ে গেছে। সিপাহি-জনতার উত্তাল তরঙ্গমালায় সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া উঠে আসেন জাতীয় নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে নেতৃত্বের অসীম শূন্যতায়। সময়টা ছিল জাতির জন্য সত্যি চরম ঝুঁকিপূর্ণ-মহাক্রান্তিলগ্ন। সেনাবাহিনীতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। নেই চেইন অব কমান্ড, নেই সেনারীতি-নীতি। সৈনিকরা সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে সবাই রাজপথে, লোকালয়ে জনতার সঙ্গে অস্ত্রহাতে। জিয়ার জন্য এটা ছিল এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা তখন সহজ কাজ ছিল না। খাঁচা থেকে যেন বাঘ লোকালয়ে বেরিয়ে এসেছে, তাকে আবার ব্যারাকের মধ্যে ফিরিয়ে আনা কঠিন। জেনারেল জিয়ার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহসিকতা, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, দেশবাসীর চরম আস্থা, জিয়াকে জাতীয় এই চরম সংকট উত্তরণে সাহায্য করে।
জেনারেল জিয়া উল্কার মতো ছুটে চলেছেন প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত, এক সেনানিবাস থেকে আরেক সেনানিবাস, এক ব্রিগেড থেকে আরেক ব্রিগেড, এক ইউনিট থেকে আরেক ইউনিট। বাংলাদেশের প্রতিটি সেনাছাউনি তিনি চষে বেড়িয়েছেন। জনতার ঢল, সৈনিকের ভিড়, এর মধ্য দিয়ে দৃপ্ত পদভারে সামনে এগিয়ে চলেছেন।
আমার মনে পড়ে ঢাকা সেনানিবাসে তিনি এ সময় এক সৈনিক দরবারে এসেছিলেন। মাঠে অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের ভিড়। চতুর্দিকে মুহুর্মুহু স্লোগান— ‘জিয়া ভাই জিয়া ভাই’। ঢাকা সেনানিবাসের আকাশ-বাতাস মুখরিত। পতাকাবাহী গাড়ি রাস্তায় রেখে তিনি হেঁটে সৈনিকদের ঠিক মাঝখানে চলে আসেন। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, Shut-up. I am not Zia Bhai. I am bloody well your Chief. Behave properly. ‘তোমরা সবাই চুপ কর। আমি তোমাদের ভাই নই। আমি তোমাদের সেনাপ্রধান। সাবধানে কথা বল। সেনাশৃঙ্খলা ভঙ্গ আমি কখনো সহ্য করব না। ’ তিনি সবাইকে ব্যারাকে যাওয়ার আদেশ দেন। অস্ত্র জমা দিতে বলেন এবং চেইন অব কমান্ডে ফিরে আসতে বলেন। অবাক বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করি, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ, সৈনিকরা লাইন ধরে একে একে শৃঙ্খলার সঙ্গে আপন আপন ইউনিটের দিকে হেঁটে চলছে। আমার কাছে সেদিন জিয়াকে মনে হয়েছিল তিনি যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক। যার বাঁশির সুরে হ্যামিলন নগরীর সব শিশু-কিশোর যে যেখানে ছিল তার পেছনে ছুটে চলেছে।
জেনারেল জিয়া তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হীনমন্যতায় ভোগা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তার প্রাইড ফিরিয়ে দেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জাতীয় সেনাবাহিনীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। সেনাবাহিনীকে সুপ্রশিক্ষিত পেশাগতভাবে সুদক্ষ অস্ত্র ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক মনোযোগ দেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশা-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী হিসেবে জনগণের পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করে। জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার মূর্তপ্রতীকে পরিণত হয় আক্ষরিক অর্থেই।
জিয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘জনগণ এবং জনগণই একমাত্র সকল ক্ষমতার উৎস’। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো, সামরিক সরকারের পূর্ণ বেসামরিকীকরণ। তিনি সব রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রচর্চার পূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। আওয়ামী লীগ তখন একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছিল। ইতিপূর্বে বাকশালের ধারালো ছুরিতে দল দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। দলের অনেক শীর্ষ নেতা মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছিলেন। জিয়া তাঁকে নিজ দেশে সসম্মানে ফিরে আসার সাদর আহ্বান জানান। তাঁকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পূর্ণ সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করেন।
বাংলাদেশের তদানীন্তন রাজনীতির বাস্তবতা জেনারেল জিয়াকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে বাধ্য করে। তাঁর ছিল গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। সত্যিকারের গণতন্ত্রের চেতনায় তাড়িত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম সুযোগেই তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটান। সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি কৃষিবিপ্লব ও শিল্পের বিকাশ ঘটান। জাতিকে একটি মর্যাদাশীল সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড় করান।
জিয়ার শাসনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সুবর্ণ যুগ। তিনি ’৭১-এর মতো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রচনা করেন। অতি কাছের শক্তিশালী গণচীনসহ অনেক বৃহৎ দেশ বাংলাদেশের প্রতি মৈত্রী ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির অতিসম্মানীয় আসন অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানকে নির্বাচনে পরাজিত করে বাংলাদেশ অর্জন করে। জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একত্রিত করে শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক জোট গঠনে উদ্যোগ নেন। সার্ক এককভাবে জিয়ার চিন্তাপ্রসূত।
জিয়া সেনাবাহিনী থেকে মেয়াদ পূরণের অনেক আগেই স্বেচ্ছায় পূর্ণ অবসর গ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে তিনি নিজে দল গঠন করেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে শহরে-বন্দরে পথে-প্রান্তরে বিরামহীনভাবে ঘুরে বেড়ান। জনগণের সঙ্গে তাদেরই পরিবারের একজন হয়ে যান। তিনি শত শত মাইল পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়ান। মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শোনেন। সাহস জোগান। মানুষ তাঁকে আপন করে নেয়। গৃহবধূরা তাঁকে বাড়ির ভিতরে উঠানে নিয়ে বসান। রান্নাঘরে মাটির সানকিতে ঘরে যা আছে খেতে দেন। বৃদ্ধারা শুধু মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন। আবালবৃদ্ধবনিতা হ্যামিলনের সেই বংশীবাদকের মতো তাঁর পেছনে স্রোতধারার মতো ছুটে চলে। বিশ্বে তিনি খ্যাত হন চারণ রাষ্ট্রপতি নামে। গোটা বাংলাদেশটাই হয়ে ওঠে জিয়ার আপন ঘর। পৃথিবীর খুব কম সমরনায়কই রাজনীতির অজানা অঙ্গনে এত অল্প সময়ে এমন জনদরদি জননেতা হতে পেরেছেন। একজন সমরনায়কের এমন আমূল পরিবর্তন, রণ থেকে জনে এমন বিশাল বিবর্তন সত্যি বিরল। সমরনায়ক জিয়া নিজেকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিলে তিলে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন নিখাদ, নিষ্কলুষ এক জনগণমন অধিনায়ক জিয়া করে। জিয়াকে তাঁর সপ্ততৃংশ শাহাদাতবার্ষিকীতে আমার হৃদয় উজাড় করা বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।