সম্প্রতি বড় ধরনের একটি পরিবর্তন হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মেজর জেনারেল অং সোয়েকে গত শুক্রবার সেনাবাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সেখানে তিনি দায়িত্ব নেবেন বিশেষ অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখার।
মেজর জেনারেল পদ থেকে লেফট্যানেন্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে অং সোয়েকে। এখনো মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ না করলেও শীঘ্রই করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি সেনাবাহিনীর ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন(বিএসও) এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। বিএসও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডগুলো তত্ত্বাবধান করে এবং সরাসরি সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লাইং এর কাছে রিপোর্ট করে। এছাড়া নতুন দায়িত্বের আওতায় লেফট্যানেন্ট জেনারেল অং সোয়ে বিএসও-৬ এর দায়িত্বও পালন করবেন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে এই কমান্ডটির প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল অং কিয়াও জংকে সরিয়ে দেয়া হয়। আর মন্ত্রীসভায় লেফট্যানেন্ট জেনারেল অং সোয়ে’র জায়গায় আসতে যাচ্ছেন ডিফেন্স সার্ভিস অ্যাকাডেমির বর্তমান প্রধান মেজর জেনারেল অং থু।
লেফট্যানেন্ট জেনারেল অং সোয়ে ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমি থেকে উঠে এসেছেন। এর আগে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ৩৩ ডিভিশন উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক কমান্ডের প্রধান হিসেবে। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী থেই সিয়েনের প্রশাসনেও তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাবেক জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল লা তে উইন বলেন, কোন সেনা কর্মকর্তা মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়ার পর আবার সেনাবাহিনীতে ফিরে আসা ও পদোন্নতি পাওয়ার ঘটনা বিরল মিয়ানমারের ইতিহাসে। তিনিই সম্ভবত এ ধরনের প্রথম ব্যক্তি।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারে সেনাবাহিনী। দীর্ঘদিনের সেনা শাসনে পিষ্ঠ দেশটিতে এমন অদ্ভুত সংবিধান প্রণীত হয়েছে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থাগাউং ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক কো ইয়ে মিয়ো হেইন মনে করেন, রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সঙ্ঘাত ও পরবর্তি পরিস্থিতির সাথে সম্পর্ক রয়েছে এই পরিবর্তনে।
ইয়াঙ্গুনের আরেক সামরিক বিশ্লেষক ইরাওয়াদিকে বলেন, লেফট্যানেন্ট জেনারেল অং কিয়াও জংকে পশ্চিম কমান্ডের দায়িত্ব নিয়ে সাবেক কমান্ডার মেজর জেনারেল মং মং সোয়ের কর্মকা-ের দায়ভার নিতে হবে। প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যটি এই পশ্চিম কমান্ডের অন্তর্ভূক্ত। রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনে প্রধান ভুমিকা পালন করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
গত বছর পশ্চিম কমান্ডের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখাইনের রাজধানী নেপিদোর বিএসও-৬ এ বদলি করার আগে অং কিয়াও জং বিএসও-৩ এর দায়িত্বে ছিলেন। সে কমান্ডটি দক্ষিণ পশ্চিম, দক্ষিণ ও পশ্চিম সামরিক কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া যৌথ যুদ্ধবিরতি তদারকি কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি, যে কমিটিটি শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছে।
ওই সময়ই রাখাইনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সবচেয়ে বেশি ভয়াবহতা লাভ করেছে। গত বছর আগস্টের পর থেকে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে।
গত এক মাস ধরেই মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে বড় ধরনের অনেকগুলো পরিবর্তন হয়েছে। পুলিশ ও অন্যান্য কয়েকজন বড় কর্মকর্তাকে বরখাস্ত কিংবা বদলি করা হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববারও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল নই নই সোয়ে, ও ১০১ ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মং মং জানকে বরখাস্ত করে পরে আবার সহায়ক প্রতিষ্ঠানে পোস্টিং দেয়া হয়েছে।
কো এ মিয়ো হেইন মনে করেন, আরো পরিবর্তন আসতে পারে। তিনি বলেন, গত মাসে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতাদের মিয়ানমার সফরের সময় সেনাপ্রধান বিতর্কীত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এটি তারই অংশ।
ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন বা বিএসও’র নতুন প্রধান অং সোয়ের ভালো সম্পর্ক রয়েছে রাজনীতিবীদ ও মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের সাথে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তার প্রশাসনের অন্য সব স্তরের কর্মকর্তাদের সাথেই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেক মন্ত্রী ও এমপি তার সেনাবাহিনীতে ফিরে যাওয়ার ঘটনাকে তাদের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষের এমপি ইউ নে মিয়ো তুন ইয়াঙ্গুন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি খুবই আন্তরিক ও সহযোগীতাপরায়ন। তাকে হারিয়ে আমাদের ক্ষতি হয়েছে।
অনেক দিন ধরেই রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও পররাষ্ট্র বিভাগ মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে তাদের কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। গত বছরের সর্বশেষ রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল দেশটির সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেশের কোন জনগোষ্ঠিকে এমন নির্মূল করার ঘটনা হিটলারে নাৎসি বাহিনীর পর আর বিশ্বে দেখা যায়নি।
গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হলেও মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির নিবর সমর্থন ছিলো রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে।
যেখানে গিয়ে রোহিঙ্গারও দুঃখের কথা ভুলে যায়
দ্য গার্ডিয়ান
মিয়ারমারের রাখাইনে এখনো নির্যাতন চলছে। এখনো পালাচ্ছে মানুষ। এমনই ৭৯ জন রোহিঙ্গা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে একটি নৌকায় করে গন্তব্যহীন পথে যাত্রা শুরু করে। একপর্যায়ে তারা পৌঁছায় থাইল্যান্ডের কাছে। কিন্তু সেখানকার নৌবাহিনী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং অন্যত্র রওনা করিয়ে দেয়। অনিশ্চয়তা আরো বাড়ে। একপর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া যাওয়ার। কিন্তু তার আগেই তারা পৌঁছে যায় আচেহ প্রদেশে। এটি ইন্দোনেশিয়ার ওই এলাকাগুলোর একটি যেখানে পুরোপুরি শরিয়া শাসন চলে। ২০০৪ সালে সুনামিতে যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই আচেহ তার একটি। কিন্তু ওই রোহিঙ্গাদের কাছে আচেহদের যে পরিচয়টি সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে সেটি হলো- বিশ্বে এটিই একমাত্র এলাকা, যেখানে খোলাখুলিভাবে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানানো হয়। যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভাইবোনের মতোই মনে করা হয়।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুহীন একটি সম্প্রদায়। তাদের বাড়িঘরে হামলা ও নির্যাতন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের হিসাবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
২০১৫ সালে এখানে প্রথম ৯ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। তারপর হতে এ পর্যন্ত ১৭৪০ রোহিঙ্গা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।
বাবা-মায়ের মতো যত্ন নেয়
রোহিঙ্গারা যখন এই এলাকায় নামে, তখন তাদের বুক দুরুদুরু করছিল। কারণ তারা জানত না, তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে। কিন্তু নামার পরে যখন স্থানীয়দের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় তখন তাদের সব ভয় উবে যায়। কারণ তারা এখানে খাবার, ওষুধ, আশ্রয় সবকিছুই পায়। আইওএম এবং স্থানীয় কিছু সমাজকল্যাণ এজেন্সির আওতায় তাদের আপাতত থাকতে দেয়া হয় একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে। রমযানের পরই তাদেরকে ল্যাঙচা শহরে আরেকটু ভালো ও স্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। রোহিঙ্গারা এখানে এসে তাদের দুঃখের অনেকটাই ভুলে যায়। তারা এজন্য অন্তর থেকে আচেহবাসীদের ধন্যবাদ জানাতে চায়।
অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা
এখানে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তারা অম্ল-মধুর অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এখানে তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছে, তার জন্য তারা আনন্দিত। কিন্তু তাদের পরিবারের অন্য যে সব সদস্য রাখাইনে রয়ে গিয়েছে, তাদের জন্য দরকার অর্থের। আর সে জন্য দরকার কাজের। রোহিঙ্গাদের অনেকেই তাই মালয়েশিয়ায় চলে যেতে চায়। কারণ সেখানে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের কোনো কাজ করার অনুমতি নেই, তবুও তারা সেখানে বিভিন্ন পন্থায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে। দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, আচেহতে তারা যেভাবে সমাদর পেয়েছে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থা অনেকটাই ভিন্নতর। আবার মালয়েশিয়াতে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থাও তাদের জন্য ঠিক করা নেই।
আবাসনের ব্যবস্থা
আচেহর বিরেউয়েন, যেখানে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, সেখানে ঘিয়ে এবং গাঢ় সবুজ রঙের ভবন রয়েছে। সেখানে পুরুষ ও নারীদের পৃথক ডরমিটরি রয়েছে। রয়েছে একটি মসজিদও সেখানে সবাই মিলে নামাজ আদায় করেন। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে সেখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ক্লিনিকও। সেখানকার তরুণ-যুবক আচেহ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের দায়িত্ব পালনে বেশ তৎপর। কারণ তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা আমাদের ভাই, আমাদের মুসলিম ভাই। আর আমি বা আমরা যা করছি তা আহেচনিজ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।
ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে যখন এ ক্যাম্প পরিদর্শন করা হয়, তখন তারা বলেন, রোহিঙ্গারা এখানে খুবই ভালো আছেন। রোহিঙ্গারা যখন এ ব্যাপারে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে যায়, তখন কৃতজ্ঞতায় তারা কেঁদে ফেলে। আচেহনিজরা খুবই ধার্মিক, অমায়িক ও সহায়ক।
আমি এখনো বেঁচে আছি
আচেহর ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা জুলফিকারও ওই ক্যাম্পেই ঘুমাতেন। তিনি আনন্দের সাথেই বলেন, আমি ২২ দিন ধরে আমার স্ত্রীকে দেখিনি। আচেহর সামুদ্রিক আইন হিসেবে, আমরা কোনো আগমনকারীকে ধর্ম, বর্ণ বা কোনো কিছুই জিজ্ঞাসা করি না। কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জীবন বাঁচানো, তার জাতীয়তা নয়।
তিনি বলেন, ২০০৪ সালের সুনামির পরও আমি বেঁচে আছি। অথচ ওই সময়ে এ এলাকাতে মারা গিয়েছিলে লক্ষাধিক লোক। সুতরাং আমরা জানি এ ধরনের বিপর্যয়ের পর বেঁচে থাকতে কতটা ভালো লাগে।
রমজানের ব্যস্ততা
প্রথম রমজানে ইফতারের সময় ছিল ৬টা ৪৫ মিনিটে। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছিলেন। ইফতারের জন্য রান্না করা হচ্ছিল ভাত, মাছ, নুডুলস, শসার সালাদ, নারকেলের দুধে গরুর গোসতের তরকারি, বেগুন ভাজা ইত্যাদি। এগুলো সবই এসেছে অনুদান থেকে। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউও রান্না করছিলেন, আবার কেউ বা জুস তৈরি করছিল।
মাগরিবের আজান হতেই পুরুষরা এক দিকে এবং নারী ও শিশুরা আরেক দিকে ইফতারি করতে শুরু করে। খেজুর, স্থানীয় মিষ্টান্ন ইত্যাদি দিয়ে ইফতার শুরু করা হয়। ইফতার শেষে পুরুষরা মসজিদে সবাই একসাথে নামাজ আদায় করতে ছুটে যায়, অন্য দিকে নারীরা তাদের ডরমেটরিতে নামাজ আদায় করে নেয়। সব কিছুর পরও তাদের কারো কারো মনে হাহাকার রয়েই যায়। বিশেষ করে যাদের পরিবার-পরিজন অন্য কোথায় আশ্রয় নিয়েছে, তারা কিভাবে রয়েছে, ভবিষ্যৎ কী এসব তাদের মনে মাঝে মধ্যেই চিন্তার ঢেউ তোলে।