টেলিভিশন মিডিয়ামে একটি স্রোত বইছে। বলা যেতে পারে ঘূর্ণী।
এই ঘূর্ণীপাকে আবর্ত সকল মিডিয়াকর্মী। বিশেষ করে টেলিভিশন নাটক। অতিসম্প্রতি টেলিভিশন নাট্যজনদের আলোচনার মূল বিষয় নাটকের মান ও দাম। কেউ বলছে দাম বাড়ালে মান বাড়বে, আবার কেউ বলছে মান বাড়ালে দাম বাড়তে বাধ্য। সত্যিকার অর্থেই টিভি নাটক ব্যবসা এখন অনেকটাই যেন অরাজকতায় পরিপূর্ণ। কোন নিয়ম নেই, নীতি নেই। যার যা খুশি তাই করছে। অরাজকতাময় এই মহামন্দা বাজারের পাড়ে দাঁড়িয়ে যারা সমাধানের কথা ভাবছেন, তারা নিজেরা জানেন সমাধান খুব সহজ না।
কারণ-নিজেদের তৈরি করা ‘ভাগ বাটোয়ারা’ কালচারের সমস্যা সমাধান করবে কে? দেখা গেছে, নাটকের বাজার কে কত ভাগে ভাগ করে চেটেপুটে খাবে, তার প্রতিযোগিতা চলছিল বহুকাল।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কীভাবে তারা এই সমস্যা তারা তৈরি করেছে, আলোচনা করা যাক।
প্যাকেজ নাটক কাল:
বিটিভি’তে শুরু থেকে নব্বই দশক এর আগ পর্যন্ত খুব ভালো ভালো নাটক নির্মাণ হতো। নব্বই দশকের পর নাটকের মান কমতে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন, এজন্য বিটিভির কিছু কর্মকর্তা ও প্রযোজক দায়ী। তাদের দুর্বলতার সুযোগে বিটিভির নাটকের কাজ ও মান নিয়ে বির্তক শুরু হল।
তখনকার এই বির্তকই প্যাকেজ নাটকের পথ সুগম আর পরিস্কার করলো। এলো প্যাকেজ নাটকের ঢেউ। সম্পূর্ণ নাটক বাইরের থেকে বানিয়ে এনে বিটিভিতে প্রচার করা হলো। তাতে নাটক খানিকটা প্রাণও পেলো, টেলিভিশনের ইনডোর সেট থেকে নাটক হলো মুক্ত। অনেক ধরনের গল্প আর ভিন্ন নির্মাণ দেখতে পেলো দর্শক। অবশ্য বলে রাখা ভালো, কিছু উন্নত নাটক হবার বড় কারণ ছিল একদল তরুণ উদ্যমীর নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার।
১৯৯৪ সাল থেকে এই ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ভালোভাবেই কেটে গেলো কিছু বছর। খুব ভালোমানের অনেক নাটক নির্মাণ হল, দর্শকপ্রিয়তা পেলো। তখন আমাদের মনে হয়েছিল, এই বুঝি সংকট কেটে গেল। তবে ঘোর কাটল কিছু বছর পরই। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারলো, আসলে সংকট কাটেনি বরং নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। কীভাবে?
কিছু প্রোডাকশন হাউজের অতি মুনাফা আর অসৎ কর্মের বলিতে প্যাকেজ নাটকের মান আর প্রাণ হারাতে লাগলো। টেলিভিশনে নিম্নমানের নাটক ঘুষ দিয়ে চালাতো একশ্রণির ফড়িয়া আর প্রযোজক। এও জানা গেছে, বিটিভির কিছু কর্মকর্তার সাথে আঁতাত রেখে ঘুষ বাণিজ্য চলেছিল বেশ রমরমাভাবেই।
স্যাটেলাইট চ্যানেলের সময়কাল:
স্যাটেলাইট চ্যানেল এর আবির্ভাব হলো ১৯৯৭ সালের দিকে। তারপর থেকে নাটকের আরেক দিক উন্মোচন হলো। এই ভাবে চললো কিছু কাল। তারই মাঝে কিছু ভালো ভালো প্রোডাকশন দেখলাম। মেধাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা গেল। নাটক তার প্রাণ ফিরে পেলো। তবে ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো কয়েক বছরের মধ্যে ভালো নাটকের অভাব দেখা দিলো। আবার এলো নতুন সংকট। এই সংকট কিন্তু ভাগ বাটোয়ারার সংকট। কিসের ভাগ বাটোয়ারা? এই ভাগ বাটোয়ারা হলো- নাটকের ঠিকাদারির ভাগ বাটোয়ারা।
নির্মাতাদের হাত থেকে নাটক চলে গেলো বণিক শ্রেণির হাতে। এই প্রক্রিয়া দোষের কিছু না, বরং ভালো হবার কথা, তা না হয়ে দেখা দিলো আরেক সমস্যার। নাটক বণিক শ্রেণির হাতে না গিয়ে চলে গেলো নব্য ঠিকাদার শ্রেণির কিছু কুরুচিপূর্ণ মানুষের হাতে। বলে রাখা ভালো, এখানে অবশ্যই পেশাদার এবং ভালো মন মানসিকতার মানুষ ছিলো, ভালো ব্যবসায়ীও ছিলো। কিন্তু কুচক্রীর সাথে ব্যবসায় পেরে ওঠেনি তারা। স্যাটেলাইট চ্যানেলের শুরুতে মঞ্চের অভিনেতা অভিনেত্রীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। হতে বাধ্য, কারণ অভিনয় শিল্পী তৈরিতে মঞ্চই প্রধান।
সংকট আরেকধাপে নামল- অযোগ্য আর অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় নাটকের মান যা-তা করে ফেললো, নাটকে না পাওয়া গেলো ভালো গল্প, না পাওয়া গেলো ভালো অভিনয়। নাটকের আর্ট ডিপার্টমেন্ট, মেকাপ, গেটআপের আর গল্পের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ল সেই ঠিকাদার শ্রেণি। চ্যানেলগুলোতে নিম্নমানের নাটক প্রচার হতে লাগলো বিশেষ ব্যবস্থায়। তখনকার চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিেদর কেউ কেউ এর দায় কীভাবে এড়াবে?
আবার সংকট কাল:
সে সময়ে সংকট উত্তরণে কি ধরনের ভূমিকা তারা পালন করেছিল, আমাদের তা জানা প্রয়োজন। দেখা গেল নিমার্তা আর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান শুধু নিজেদের লাভের কথা ভেবেছে। কী করলে নিজেরা লাভবান হবো, অন্যদিক ক্ষতি করে হলেও দিনের পর দিন মাসের পর মাস এই অসুস্থ চর্চা চলতে থাকে। তবে যাদের জন্য এতো আয়োজন, সেই দশর্কদের সব সময়ই উপেক্ষা করেছে বার বার। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দর্শকদের অবমূলায়ণ আর অসম্মান করতে করতে এক সময় দশর্করা মুখ ফিরিয়ে নিল বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের নাটক থেকে। নাটক প্রচুর হল, কিন্তু দর্শক তৈরি হলো না। প্রয়োজন ছিল আমাদের কালচার ও রীতিনীতি বজায় রেখে নাটকের দর্শক তৈরি করা। বিকট আর উদ্ভট অনাটক দেখে দর্শকরা এক সময় বিরক্ত হয়ে নাটক দেখাই বন্ধ করে দিয়েছে।
সৌখিন প্রযোজক কাল:
সংকটেই সমাধান, তাই পরিবর্তন এলো আরেকবার। যখন কোন একটি ভাবনা বা আইডিয়া ব্যর্থ হয়, তখন চারদিক থেকে নতুন নতুন আইডিয়া এসে ভীড় করে, তার শূণ্যস্থান পূরণ করে। সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকায় নাটক চলে গেলো অশিল্পীদের হাতে, (সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন নয়, এমন সব লোক) যারা না বোঝে শিল্প, না বোঝে বাণিজ্য। দু’টো জিনিসের প্রতি তাদের বিশেষ ঝোঁক দেখা গেল। অশিল্পীরা শিল্প খুঁজলো নারী দেহে, আর লোকেশন আর নাটকের শুটিংয়ের আড়ালে বিদেশ ভ্রমণে (নোংরামিতো আছেই)। শুরু হল নাটকে থাই-নেপাল কালচার।
এজেন্সি কাল:
অবধারিতভাবে ভাগ বাটোয়ারের বাঁক পরিবর্তন হলো আরেকবার। প্রায় ভেঙে পড়া টেলিভিশন চলতে লাগলো ধুঁকে ধুঁকে। ঠিক মতো টাকা পয়সা দিচ্ছিল না তারা। নির্মাতা আর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খানিকটা অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে বাহিত হচ্ছিল। এই অচালবস্থা বেশিদিন চললো না। টিভি নাটকের ইতিহাসের বাঁক বদলায় আবার।
বাঁক পরিবর্তনের ঘুম ভেঙ্গে দেখা গেল- প্রোডাকশন হাউজ আর চ্যানেলে ইন হাউজ থেকে নাটক চলে গেলো বিজ্ঞাপনী এজেন্সির কাছে। আফ্রিকার ধর্মযাজক ডেসমন্ড টিটো’র একটি কথা মনে পড়ল। ‘সাদা চামড়ার মানুষ যখন এ দেশে (আফ্রিকা) এলো, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আর আমাদের ছিল মাটি। তারা আমাদের হাতে বাইবেল দিয়ে বললেন, ধরো, চোখ বন্ধ করো, ধ্যানস্থ হও। আমরা চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্ত হলাম। চোখ খুলে দেখি, তাদের বাইবেল আমাদের হাতে, আর আমাদের মাটি তাদের কাছে’।
অনেকেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ধ্যানস্থ হলো এজেন্সির দুয়ারে। ধ্যান ভাঙার পর দেখে, টেলিভিশন চ্যানেলের প্রায় সব নাটক এজেন্সির হাতে। শুরু হলো টেলিভিশন নাটকের নতুন অধ্যায়।
ভাগবাটোয়ারা শুরু হলো শুরুতেই। কয়েকটা এজেন্সি ধীরে ধীরে টিভি চ্যানেলের সব নাটক দখল করে নিলো অল্প সময়ে, খুব দক্ষতার সাথে। টিভি চ্যানেলের চতুর কর্মকর্তারা চ্যানেল মালিকদের বুঝাতে সক্ষম হলো, আমাদের কোন সমস্যা নেই স্যার। ওরাই নাটক চালাবে, ওরাই বিজ্ঞাপন দিবে।
এভাবেই চলল, এবং আবার সংকট দেখা দিল। সমস্যাতো হবেই, কারণ তারাতো স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবেনি, তারা চালাকি করেছে, আর রূপ পাল্টিয়েছে। তারপর যা হবার তাই হলো- এই ব্যবসায় কিছু অসাধু কর্মকর্তারা ফুলে ফেঁপে উঠলো। আর পূর্বের মতো নাটকের মান নিচের দিকে নামতে শুরু করলো নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো। এক চ্যানেল সাথে অন্য চ্যানেলের কাজের মানের পার্থক্য থাকতো না, আয়েরও পার্থক্য থাকতো না, এই কথাটা তখন যদি চ্যানেল মালিকরা খেয়াল করতো তাহলেও এই সংকট এড়ানো যেতো।
এজেন্সির দেওয়া নাটক এখন সবগুলো চ্যানেলে মহাউৎসবে চলছে, বিজ্ঞাপনের ঘাটতি নেই। তবে দর্শক দেখছে না। আর এই পচন শুরু হয়েছিল দূর্বল পরিচালক আর প্রযোজকের হাত ধরে। যারা নিজেদের যোগ্য মনে করেনি, তারা নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে আশ্রয় নিয়েছে বিজ্ঞাপন এজেন্সির কাছে (এর মাঝে কেউ কেউ নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে)। ভাল নাটক হয়নি এমন নয়, এজেন্সিগুলো কিছু কাজ দক্ষ নির্মাতাদের দিয়েও করিয়েছে। এটা তাদের একটা কৌশল ছাড়া আর কিছু না। অনেক খারাপ, আর মানহীন পণ্যের ভীড়ে দু’একটা ভালো নাটক ছিল একটা ফ্যাশন, যদিও তারা নাকি এই ভালো পণ্য দিয়ে খুব একটা লাভ করতে পারেন নাই। তবে ভালো এবং মানসম্পন্ন প্রোডাকশনএ যে একটা আছে, তা ছিল তাদের ছিল ব্যবসায়িক অলংকার আর খানিকটা গর্বের। দেখা গিয়েছে, অনেক গুণী নির্মাতাও নিরুপায় হয়ে তাদের কাছে গিয়েছিল। সময়ের এই সুযোগে রাতারাতি অযোগ্য নির্মাতাদের ত্রাতা হয়ে উঠলো কিছু এজেন্সি এবং আবির্ভাব ঘটলো আরেক শ্রেণির নির্মাতার।
বিজ্ঞাপণ কাল:
এখনতো আমরা সবাই জানি, শতকরা ৯৫ ভাগ নাটক এজেন্সির হাত ধরে টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এসব নাটক কতটা মানসম্পন্ন তা দর্শকরাই ভালো করে বলতে পারবে। এমনিতে যে মানের নাটক নির্মাণ হয়, তা দিয়ে দর্শক ধরে রাখতে পারছে না, তার উপর আবার চ্যানেলের ভূমিকা এতোটাই হতাশাজনক যে, যেমন খুশি তেমন সাজার মতো, যত খুশি তত বিজ্ঞাপন চালানোর প্রতিযোগিতা শুরু করলো তারা। দর্শকের চাহিদার প্রতি নূন্যতম সম্মান না দেখানো ফলে আবারও দর্শকরাও চলে গেলো চ্যানেল ছেড়ে।
এখন হাহাকার করছে সবাই। নির্মাতা, প্রযোজক, বিজ্ঞাপনী সংস্থা। কোন কিছুর বিনিময়েও দর্শক ধরে রাখতে পারলো না। বোঝা প্রয়োজন, দর্শক কারো কাছে দায়বদ্ধ না। তারা তাদের পছন্দের চ্যানেল ঠিকই বেছে নিয়েছে। এখন দর্শকদের একটা বড় অংশ ভারতীয় চ্যানেল দেখে। যেখানে ঝকঝকে ছবি আছে, গল্প আছে, আর দর্শকদের বিরক্ত করে এমন অনিয়মের কোন বিজ্ঞাপন নেই।
দর্শক জরিপ
‘এমআরবি বাংলাদেশ’ ঢাকা চট্রগ্রাম বিভাগের গ্রাম-শহর মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি মানুষের (যাদের টিভিতে ক্যাবল সংযোগ আছে এবং যাদের বয়স চার বছরের উপর) উপর জরিপের একটি চিত্র আমারা দেখতে পাই।
১. গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ থেকে ১ কোটি কোটি ২২ লাখ (শতকরা হিসেবে ৬১% থেকে ৬৪ %) লোক টিভি দেখে এবং তারা গড়ে প্রায় ২.৭৫ ঘণ্টা সময় সেখানে ব্যয় করে।
২. তারমধ্যে আমাদের দেশীয় ৩০টি চ্যানেলে ৮১ থেকে ৮৭ লাখ দর্শক (১৫% থেকে ১৮%) সময় ব্যয় করে।
৩. অবশিষ্ট প্রায় ৩৫ লাখ (১৮%) দর্শক দেশীয় টিভি চ্যানেল ১ মিনিটের জন্যও দেখে না।
বিষয়টা ভয়াবহ। শুধু ভয়াবহ না আমাদের জন্য অশনি সংকেত। আরেকটা ভয়াবহ মজাদার সংবাদ হলো, আমাদের ৩০টি টিভি চ্যানেল যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে। শুধু স্টার জলসা’ ই সে পরিমান সময় ব্যয় করে।
স্টার জলসা = আমাদের ৩০টি চ্যানেল।
তাহলে কি দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই, ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে, এবং যথাযথ ভাবে প্রচার করতে হবে।
টেলিভিশন সিরিয়াল:
টেলিভিশন দর্শকদের মধ্যে (বয়স ১৫ থেকে ৬০ বা তারও উপরে, মহিলা দর্শক) বড় অংশ দেশীয় টিভি সিরিয়াল দেখে। আমাদের লোকাল চ্যানেলের টিভি ড্রামা সিরিয়াল যারা দেখে, তাদের মধ্যে শুধু একটি টেলিভিশন চ্যানেলেই (যারা মেগা সিরিয়াল দেখায়) ৩০ ভাগ সময় ব্যয় করে। বাকী ৭০ ভাগ সময় ব্যয় করে অন্যান্য দেশীয় টিভি চ্যানেলের নাটকে। টিভি সিরিয়ালে অন্যান্য চ্যানেল যদি উন্নতি করতে পারে, তাহলে বিদেশী সিরিয়াল দেখা অনেকটাই কমে যাবে। দর্শক তখন আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলে সময় ব্যয় করবে, আর মালিক পক্ষ অনেক টাকা আয় করতে পারবে।
সূত্র: KANTAR MRB TAM. Week 18, (date 28 April to 04 May 2018)
দর্শকদের মান:
এখন দর্শকদের মান নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে, তাদেরকে নানাবিধ ব্যঙ্গাত্বক উপাধিও দেওয়া যেতে পারে, তবে কোন লাভ হবে না। সবাই জানে এখানে নানা বয়সের নানা শ্রেণির দর্শক রয়েছে, সবাইকে আমলে নিতে হবে। শুধু এক শ্রেণির দর্শকদের নিয়ে কাজ করলে অন্যরা কি করবে? সেই অন্য শ্রেণির দর্শকের সংখ্যা বিশাল- যাদের সব সময় উপেক্ষা করা হয়েছে।
দর্শক ফেরানোর আয়োজন:
এখন, এই সময়ে শুরু হলো আলোচনা। আমাদের দর্শক ফেরাতে হবে। ঘরের দর্শক ঘরে আনতে হবে। নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে, আবার কেউ বলে, ভালো নাটক নির্মিত হলে বাজেট এমনিতেই বাড়বে। এই নিয়ে তর্ক চললো, সমালোচনা হচ্ছে, একে অপরকে দায়ী করছে, দোষারোপ করছে-এবং দোষ বিনিময় হচ্ছে। এই ‘বিনিময়ে’ ঘুরপাক খাচ্ছে নির্মাতারা। যারা সত্যিকার অর্থেই ভালো কাজ করতে চায়। এই সংকট উৎরানোর উপায় কি হতে পারে, সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা চায়ের টেবিল আর গলির মুখে আটকে আছে। যদিও কেউ কেউ খানিকটা উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে কিছুই হয়নি। অমুক গেলো, তমুক গেলো বলে আলাপ চললো, বিলাপ করলো, কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার দোহাই দর্শক মানলো না। সত্যিকারের অর্থে, দর্শক এতো কিছু বুঝতে চাইবে না। তার কাছে সমগ্র পৃথিবী উন্মুক্ত। বিনোদনের জন্য সে কার আশায় বসে থাকবে? বলা হয়ে থাকে গ্লোবাল ভিলেজ, আবার পূঁজিবাদী অর্থনীতি। এই বিকাশমান উদ্ভট অর্থনীতি আর গ্লোবাল ভূতের বৃত্তে দর্শক বিনোদিত হবার জন্য ‘দেশপ্রেম’ তত্ত্বে আস্থা রাখবে না। দর্শকের কাছে যখন যা ভালো লাগবে, তারা তখন তা-ই দেখবে। দেখার মাধ্যম যা-ই হোক। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, থিয়েটার হল বা অন্য কোথাও।
ভাগ বাটোয়ার রাজনীতি:
পূঁজিবাদী অর্থনীতি হলো ভাগের রাজনীতি, আদর্শের রাজনীতি না। তাহলে কি হচ্ছে এখন চলমান টেলিভিশন নাটকের বাজারে? আদতে চলছে ভাগের রাজনীতির অর্থনীতি। এখানে রাজনীতির অর্থনীতি বলছি এই কারণে, চলমান নাটকের এখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে। যেহেতু আদর্শ বাজার গঠনে কারও কোন ইচ্ছা নেই, তাই এই সংকট আরও তীব্র হবে এবং মহাসংকটের দিকে ধাবিত হয়ে আন্দোলনে রূপান্তর হবে, এখন হচ্ছেও তাই। কিছু মানুষ এই মহাসংকট কাল থেকে সুবিধা নিবে- যেমন নিয়েছে অতীতে। এই সুবিধা হলো ভাগের সুবিধা। যুদ্ধকালীনও দেখা যায়, এক শ্রেণির চতুর লোক ভালো ব্যবসা করে যায় সব সময়ই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও দেখা গিয়েছে জাপান, জার্মান আর ইতালিকে পরাজিত করে ভাগ বাটোয়ারা করে লুটেপুটে খেয়েছে আমেরিকা, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড।
বলতে দ্বিধা নেই। এই সংকট ভাগ বাটোয়ারের সংকট। লুটেরারা সব সময় চায় ভাগ আর পূণঃভাগ। তাহলে তাদের লুটেপুটে খেতে সুবিধা হয়। অন্তত অতীত ইতিহাসের আলোকে আমার তাই মনে হচ্ছে। যদি আদর্শিক জায়গা থেকে কোন আন্দোলন হতো, তাহলে এই টেলিভিশন ইন্ড্রাস্টিতে নাটক একটি বিশেষ মর্যাদা নিয়ে ভিন্ন একটি ইন্ড্রাস্ট্রি হতো। যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। বিশেষ করে তুরস্ক, জাপান, লাতিন আমেরিকার প্রায় সবদেশে। যারা টিভি সিরিয়াল রফতানি করে বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে।
তুরস্কের টিভি সিরিয়াল মার্কেট সম্পর্কে একটু বলা প্রয়োজন। জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে তাদের প্রতি ঘন্টার বিজ্ঞাপন মূল্য প্রায় এক লাখ ডলার। ২০১৫ সালে হিসাব মতে, তারা বিদেশে রফতানি করা সিরিয়াল থেকে আয় করেছে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। প্রায় ৭০ টি নতুন প্রোডাকশন হয় প্রতি বছর। তাদের ধারনা, পরের বছর রফতানি থেকে আয় করবে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
আমাদের নাটকের ধরণ:
প্রতিদিন নাটকের শুটিং হচ্ছে। প্রায় ২০টি টিভি চ্যানেলে নিয়মিত নাটক প্রচারিত হচ্ছে। আমাদের নাটক প্রধানত তিন ধরনের।
১. একক নাটক
২. টেলিফিল্ম
৩. ধারাবাহিক নাটক
এখন ধারাবাহিক নাটক আবার অনেক রকমের। তিন, পাঁচ, তের, ছাব্বিশ, বায়ান্ন বা একশতও বেশি পর্বের নাটক প্রচারিত হয় আমাদের টেলিভিশনে।
যেমন হওয়া প্রয়োজন আমাদের নাটকের বাজেট
ডিরেকটার গিল্ডের নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে ৫১৮ জন। অভিনয় শিল্পী সংঘের সদস্য সংখ্যা ৮০০ এর বেশি। আর প্রযোজক আছেন ২১৬ জন। নাট্যকার সংঘের সদস্য হলো ১৭৮ জন।
এতো বিশাল সংখ্যক গুণী লোকদের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হলে কাজে পেশাদারিত্ব আনতে হবে। বিভাগ অনুযায়ী নূন্যতম সম্মানী নির্ধারণ না করলে সংকট কাটবে না। আমার প্রস্তাবনা নিম্নরুপ
আমাদের টিভি ইন্ড্রাস্ট্রির সম্ভাবনা:
আমরাও পারবো। আমাদের নাটকের বাজার খুব একটা ছোট না। জানা মতে, বছরে প্রায় ৮০০ কোটি (অনুমান) টাকারও বেশি বিজ্ঞাপণী বাজার রয়েছে। হাজার হাজার নাটক নির্মাণ হয় চ্যানেলের জন্য। প্রয়োজন গুছিয়ে কাজ করা। সঠিক পরিকল্পনা করা।
দক্ষতা আর পেশাদারিত্ব মনোভাব থাকলে কয়েক বছরে আমরাও সিরিয়াল রফতানি করতে পারবো। তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৭০/৮০ টি দেশে তাদের সিরিয়াল রফতানি করে, আমরাও কম করে হলেও ৭টি দেশেতো পারবো। ২০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। খুব ভালো প্রোডাকশন হলে, ভাষা কোন বিষয় না। আমরা হিন্দি ভাষা জানতাম না, এখন তাদের টেলিভিশনের সিরিয়াল আর সিনেমার প্রভাবে এ দেশের মানুষ অনেকেই সাবলীলভাবে হিন্দি বলতে পারে। মানুষ ভাষা শিখে নেয় তার প্রয়োজনে। আমরাও অনেক দেশে বাংলা ভাষা প্রচলন করতে পারবো। আমাদের উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতি আছে, দক্ষ নির্মাতা আর লেখকও আছে। এখন প্রয়োজন বড় বড় প্রোডাকশন তৈরি করা। টিভি ইন্ড্রাস্ট্রির কাঠামোর সংশোধন করা। দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীরা কাজ করলে পাঁচ বছরে নাটক আলাদা ইন্ড্রাস্ট্রি হবে।
নাটকের নিজস্ব ইন্ড্রাস্ট্রি দাঁড় করাতে না পারলে, বছর বছর শুধু ভাগ বাটোয়ারের রাজনীতি করতে হবে, কোন সমাধান হবে না।
এবং যা করতে হবে:
আমাদের টিভি দর্শকদের আমাদের চ্যানেলমুখী করতে হলে ভালো মানের মেগা সিরিয়াল নির্মাণ ও আদর্শ উপায়ে প্রচার করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। বাংলাদেশের টিভি মার্কেটে যতগুলো পেশাদার প্রোডাকশন হাউজ রয়েছে, তাদের একসাথে বসতে হবে। কয়েকটি প্রোডাকশন হাউজ মিলে একটি চ্যানেলের জন্য মেগা সিরিয়াল বা বড় ধরনের রিয়েলিটি শো করতে হবে। সার্বিক মার্কেটের কথা বিবেচনা করে, প্রথমদিকে হলেও নিজের ঐক্য প্রয়োজন। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চ্যানেলগুলোর সাথে বসতে হবে। এবং অধিকতর যোগ্য লেখক আর নির্মাতাদের দিয়ে সেই সব সিরিয়াল বা ইভেন্ট করতে হবে। তাহলে সুদিন আসবে। আবার নিজেদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা হবে, যারা ভালো করবে তারা এগিয়ে যাবে, যারা ভালো করবে না, তাদের উচিত হবে-কি কি করলে আরও মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান করা যায়, সে উপায় বের করে আবার মূল প্রতিযোগিতায় ফিরে আসা।
প্রশাসনের দায়িত্ব
টেলিভিশন সম্প্রচার নীতিমালায় অনুষ্ঠান প্রচারের বিস্তারিত বিষয় নিয়ম করে দিতে হবে। এক ঘণ্টা বা আধঘণ্টার বিরতিতে কত মিনিট বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে, তার সুনির্দিস্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং সবাইকে এটা নিয়ম মানতে হবে। নিয়ম অমান্যকারীদের শাস্তির বিধান থাকতে হবে এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে।
আমাদের টেলিভিশনের বাজার কমও না। বার্ষিক প্রায় ৮০০ কোটি টাকার (অনুমান) বেশি লেনদেন হয় এই ছোট্ট বাজারে। প্রতি ঈদে কম করে হলেও ৫০০ নাটক প্রচার হয়। তাহলে এই বিশাল বাজার আমরা কেনো অন্যের হাতে তুলে দিবো? কোনো নিজেরা এর যত্ন করবো না, বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবো না?