ঢাকা:দেশের নয় জেলায় বজ্রপাতে ২০ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে হবিগঞ্জে ছয়জন, রাজশাহীতে তিনজন কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ও নীলফামারীতে দুইজন এবং গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদীতে একজন করে মারা গেছেন। আজ বুধবার ঝড়-বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও চারজন। আজ বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের ঘটনায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- নবীগঞ্জ উপজেলার বৈলাকপুর গ্রামের হরিচরণ পালের ছেলে নারায়ণ পাল ও আমড়াখাই গ্রামের হাবিব উল্লার ছেলে আবু তালিব, মাধবপুর উপজেলার পিয়াইম গ্রামের রামচরণ সরকারের ছেলে জহরলাল সরকার, লাখাই উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের জাহেদ মিয়ার ছেলে চকি মিয়া, সুনামগঞ্জের ধাইপুর গ্রামের বসন্ত দাসের ছেলে স্বপন দাস ও সিরাজগঞ্জের নওসের মিয়ার ছেলে জয়নাল মিয়া।
এ ব্যাপারে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ জানান, আজ বেলা ১১টায় বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপালে ঘটনাস্থলেই স্বপন দাস মারা যান। প্রায় একই সময়ে মাইচ্ছার বিল হাওরে বজ্রপাতে মারা যান জয়নাল মিয়া। এ সময় আহত হন আরও চার ধানকাটা শ্রমিক। তাদের বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও জেলার লাখাই উপজেলার তেঘরিয়া হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে গুরুতর আহত হন চকি মিয়া। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণ করেন।
তা ছাড়াও একইদিন দুপুরে নবীগঞ্জের বৈলাকপুর হাওরে বজ্রপাতে নারায়ণ পাল ও আবু তালিব মারা যান। একই সময়ে মাধবপুরের পিয়াইম হাওরে নিহত হন জহরলাল সরকার।
জামালপুর
জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে মো. হাবিবুর রহমান (৫৬) নামে একজন কৃষক মারা গেছেন। আজ বুধবার সকালে উপজেলার চর আমখাওয়া ইউনিয়নের মৌলভীর চরে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত মৃত কৃষক মো. হাবিবুর রহমানের ভাতিজা দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডাংধরা ইউনিয়নের
হারুয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোস্তফা জামান কালের কণ্ঠকে জানান, তার চাচা মো. হাবিবুর রহমান আজ বুধবার সকালে অন্যান্য কৃষিশ্রমিকদের সাথে বাড়ির কাছেই ধান কাটতে যান। সকাল ৯টার দিকে বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে তিনি ধান কাটা বাদ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হন। পথে বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। খবর পেয়ে স্থানীয়রা তাকে প্রথমে স্থানীয় সানন্দবাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং পরে তাকে পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের নিকলী ও পাকুন্দিয়া উপজেলায় বজ্রপাতে দুইজন নিহত হয়েছে। নিহতরা হলেন- নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ইউনিয়নের পরিষদপাড়া গ্রামের শাহ জালাল (২৪) ও পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের আশুতিয়া গ্রামে দিপালী রানী বর্মণ (৩৫)।
এ ব্যাপারে ছাতিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন জানান, শাহ জালাল হাওরের জমি থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলি দিয়ে ধান আনার সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হামিদ জানান, বাড়ির উঠানে কাজ করার সময় বজ্রপাতে গুরুতর আহত হন দিপালী। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহের সদর উপজেলায় বজ্রপাতে আলাল উদ্দিন (৬০) নামে একজন নিহত হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে উপজেলার চর নীলক্ষীয়ায় বজ্রপাতে মারা যান তিনি ।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মাহমুদুল ইসলাম বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে আলাল উদ্দিন গরু আনতে যাচ্ছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এ ছাড়াও একই সময় জেলার মুক্তাগাছায় বজ্রপাতে আটজন আহত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মুক্তাগাছা থানার ওসি আলী আহম্মেদ মোল্লা জানান, উপজেলার নতুন বাজার গরুর হাটে বজ্রপাতে আটজন আহত হন। আহতদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন জেলার ধরমপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের দুর্বাকান্দা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে জুয়েল আহমদ (১৬) ও শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের ইসহাক আলীর ছেলে আলমগীর মিয়া (২২)।
এ ব্যাপারে ধরমাপাশা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নূর ইসলাম জানান, বুধবার দুপুরে জুয়েল মিয়া বাড়ির পাশে কাইলানী হাওরে ধান কাটতে যায়। ধান কাটার সময়ই বজ্রপাতে আহত হলে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ধরমপাশা উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাল্লা থানার ওসি দোলোয়ার হোসেন জানান, আলমগীর মিয়া ট্রলি চালিয়ে ছায়ার হাওরে যাচ্ছিলেন কাটা ধান বাড়িতে আনতে। পথে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।
মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলায় বজ্রপাতে ইয়াকুব আলী (৫০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আজ বুধবার সকালে উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের বাচামারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে দৌলতপুর থানার ওসি সুনীল কুমার কর্মকার জানান, সকালে ইয়াকুব আলী বাড়ির কাছে ধানক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মধ্যে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
নীলফামারী
নীলফামারীর জলঢাকায় বজ্রপাতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এরা হলেন উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের শালনগ্রামের আসমা বেগম (৫০) ও কাঁঠালী ইউনিয়নের উত্তর দেশীবাই গ্রামের নূর আমিন (৪৫)। আজ
বুধবার সকালে জেলাজুড়ে ঝড়ো হাওয়া ও শিলাবৃষ্টির সময় বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু হয়।
বালাগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিপন বলেন, ঝড় ও শিলা বৃষ্টির সময় আসমা বেগম তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলে। এ সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
কাঁঠালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন তুহিন বলেন, আর নূর আমিন বাড়ির উঠানে থাকা ধান বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢাকতে যান। এসময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
রাজশাহী
রাজশাহীর তানোরে বজ্রপাতে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুইজন। আজ বুধবার সকাল ৯টার দিকে উপজেরার পৃথক তিনটি স্থানে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, উপজেলার কামারগাঁ বাতাসপুর গ্রামের জমির মাঠে ধান কাটতে গিয়ে বাতাসপুর গ্রামের ডোকমান আলীর পুত্র আনছার আলী (৩০) বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ সময় আহত হন বাসাতপুর গ্রামের অনিল শাহার পুত্র আনন্দ শাহা (৩৫) ও হিরেন শাহার পুত্র টিল শাহা (৩০)।
এ প্রসঙ্গে কামারগাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসলেম উদ্দীন বলেন, নিহত আনছার আলী খুব গরীব ঘরের সন্তান। আহতরা বিপদমুক্ত রয়েছে।
এদিকে একইদিনে উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের দুবইল নামোপাড়া গ্রামের সামসুদ্দীনের পুত্র সোহাগ আলী (১৮) সকালে জমির মাঠে সেমি ডিপের কাজ করছিল। এ সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
এ প্রসঙ্গে পাচন্দর ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বলেন, নিহত সোহাগ দুবইল গ্রামের জালালের সেমি ডিপে কাজ করত। সোহাগ গরীব ঘরের সন্তান।
অপরদিকে কলমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশিদ ময়না জানান, আজ সকালে কলমা ইউনিয়নের চকরতিরাম আদিবাসী গ্রামের বেলাম হেমরমের স্ত্রী এলেনা মুরমু (৩৫) জমিতে বোরো ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন তিনি।
তানোর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা শওকাত আলী বলেন, উপজেলার দুই ইউনিয়নের তিন স্থানে তিনজন বজ্রপাতে মারা গেছে। উপজেলা সহকারী (ভূমি) কর্মকর্তাকে ঘটনা স্থলে পাঠিয়েছি। নিহতদের প্রতিজনকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল সরকারী ভাবে দেয়া হবে।
গাইবান্ধা
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় বজ্রপাতে মহর আলী (৩৫) নামে এক কৃষি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের চর কাবিলপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে। আজ বুধবার সকালে
উপজেলার উদাখালি ইউনিয়নের পশ্চিম ছালুয়া গ্রামের চরে এ ঘটনা ঘটে।
উদাখালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, বুধবার ১২ জন কৃষি শ্রমিক ওই চরে আব্দুর রউফ মিয়ার জমির বোরো ধান কাটতে যায়। সাড়ে ৯টার দিকে বৃষ্টি শুরু হলে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে কাজ ফেলে কাছের এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মহর আলী দৌড়াতে গিয়ে উল্টে পড়ে যায় এবং সে সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
নরসিংদী
নরসিংদীর মনোহরদীতে বজ্রপাতে পিয়ারা বেগম (৪০) নামের এক গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। আজ বুধবার দুপুরে উপজেলার বড়চাপা ইউনিয়নের চরতারাকান্দি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া একই উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের তারাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় ভবন ঘেঁষে একটি বজ্রপাত হয়। এ সময় বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণির ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ দুপুরে চরতারাকান্দি এলাকায় কাজল মিয়ার স্ত্রী পিয়ারা বেগম তাঁর নিজ বাড়ির উঠোনে কাজ করার সময় হঠাৎ বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পাশাপাশি একই সময়ে তারাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন ঘেঁষে আরেকটি বজ্রপাত হয়। এতে বিকট শব্দে ও আগুনের ফুলকির বিজলীতে বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির বৃষ্টি আক্তার, তামান্না, সপ্তম শ্রেণির তায়েবা আক্তার, সাদিয়া আক্তার, অষ্টম শ্রেণির স্মৃতি আক্তার, হীরা, অনিকা, রেমি, জান্নাত, মারিয়া ও নবম শ্রেণির আঞ্জুমান আরা আহত হয়। এছাড়া তারাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির সাবিহা আক্তার ও নিলা আক্তার আহত হয়। পরে তাদেরকে মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তারাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শুধু শিক্ষার্থী নয়, আমরাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে আহত শিক্ষার্থীদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে।
মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফখরুদ্দীন ভূইয়া বজ্রপাতে হতাহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন