কাকতালীয়ভাবে মে ২০১৪-তেই নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক আনন্দ গিরিধরদাসের লেখা বই দি ট্রু আমেরিকান (The True American) নিউ ইয়র্কে প্রকাশিত হয়েছে। অক্টোবর ২০১৪তে বইটি মুভিতে রূপান্তরিত করার স্বত্ব চড়া দামে কিনেছেন আমেরিকান মুভি ডিরেক্টর মিজ ক্যাথরিন বিগেলো, যিনি একমাত্র নারী বেস্ট মুভি ডিরেক্টর অস্কার বিজয়ী। বাংলাদেশের রইসউদ্দিনকে নিয়ে লেখা আনন্দ গিরিধরদাসের বইটির মুভি রূপান্তর যে বক্স অফিস হিট হবে তাতে সন্দেহ নেই। আর সেটা হলে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বিরোধী আন্দোলনও এগিয়ে যাবে। আমেরিকায় বসবাসকারী আইটি এক্সপার্ট রইসউদ্দিন এখন একজন সেলিবৃটি। নিউ ইয়র্কে নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পরে ডালাসে রইসউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধকামী শ্বেতাঙ্গ মার্ক স্ট্রোম্যান দ্বারা। তিনি গুরুতর আহত হন এবং এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। স্ট্রোম্যান দুই ব্যক্তিকে হত্যা করেন, ধরা পড়েন এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু রইসউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর যেন না হয় সে জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যান।
তবে এখনো বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থান নিতে কোনো এনজিও, সংগঠন বা সুশীলসমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দকে দেখা যায়নি। এর অন্যতম কারণ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের উগ্র নেতাকর্মী দ্বারা মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা রাজাকার অথবা যুদ্ধ অপরাধীদের সমর্থক রূপে বর্ণিত হতে পারেন সেই আশংকা।
এই ধরনের সমালোচনার উত্তরে মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলতে পারেন, যেকোনো অপরাধীদের ন্যায়বিচার তারা অবশ্যই চান এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তিও তারা চান। কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তি রূপে তারা কারোই মৃত্যুদণ্ড চান না। কারণ বহু প্রমাণ-সাক্ষ্য উপস্থিত করা সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি ছিলেন নির্দোষ। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এবং সেটা কার্যকর করা হলে, পরবর্তী সময়ে তিনি সন্দেহাতীতভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। আর সে জন্যই বিশ্বের সভ্য দেশগুলোতে ক্রমেই মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জুডিশিয়াল মার্ডার
১৯৯৯-এ রাজিব গান্ধী হত্যাকাণ্ড মামলায় যে বেঞ্চটি তিন ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন সাবেক সুপৃম কোর্ট বিচারপতি কে. টি. টমাস সেই বেঞ্চের প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি খালিস্তান সন্ত্রাসী দেবিন্দরপাল সিং ভুলারের মামলায় এই মর্মে আবেদন জানানো হয় যে, তিনি ইতিমধ্যে যেহেতু ১০ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাই তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক। কিন্তু এই আবেদনটি অগ্রাহ্য হয়। তবে এই মামলার তিনজন বিচারকের মধ্যে একজন ভিন্নমত পোষণকারী বিচারক ছিলেন বিচারপতি এম বি শাহ, যিনি ২০০২-এ ঘোষিত ভুলার মামলার রায়ে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দানের বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯৯৩-এ যুব কংগ্রেস নেতা এম এস বিটাকে লক্ষ্য করে গাড়িবোমা হামলা চালানোর দায়ে ভুলারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারপতি কে. টি. টমাস এ ক্ষেত্রে বিচারপতি এম বি শাহর সাথে একমত পোষণ করতে আগ্রহী, যদিও তিনি রাজিব গান্ধীর খুনিদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এখন বিচারপতি টমাস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যেসব আসামি ২০ বছরের অধিক কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাদের মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
সম্প্রতি ইনডিয়ান সাংবাদিক চন্দ্রানী ব্যানার্জিকে দেওয়া বিচারপতি কে টি টমাসের সাক্ষাৎকারের সারসংক্ষেপ নিচে ছাপা হলো:
প্রশ্ন: আপনি কি সর্বদা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলেন?
উত্তর: হ্যা। আমি মনে করি এটা একধরনের জুডিশিয়াল মার্ডার তথা বিচার বিভাগীয় হত্যাকাণ্ড। শাস্তি হওয়া উচিত সংশোধনধর্মী, প্রতিশোধমূলক নয়। মৃত্যুদণ্ডে আসামির কোনো সংশোধন হয় না। আইন এমন হতে হবে যাতে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মানসিক সংস্কারসাধন করা যায়। এর দ্বারা ক্ষমা করা বোঝায় না। কোনো ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা কোনো কাম্য বিষয় নয়।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে, এ পর্যায়ে দেবিন্দর সিং ভুলারকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা করা উচিত?
উত্তর: তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ এই মামলার রায় দিয়েছিলেন। এই বেঞ্চের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারক এম বি শাহ একটিমাত্র মানদণ্ডে ভিন্নমত পোষণ করেন। সেটি হচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিটি পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি শাহ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ইতিহাস সাক্ষী, পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কখনো কোনো জোরালো সাক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি। তার মতে, স্বীকারোক্তি জোরজবরদস্তি করে আদায় করা যেতে পারে। বিচারপতি শাহের ওই মতের প্রেক্ষিতে আমি মনে করি যে, রাষ্ট্রপতির কাছে যদি একটি নতুন মার্সি পিটিশন দেওয়া হয় তাহলে তিনি এসব বিষয় নতুন করে বিবেচনায় আনতে পারেন।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখার দরকার আছে?
উত্তর: স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড করা হয়নি। একজন পুলিশ অফিসার তা রেকর্ড করেন। আইন অনুযায়ী এটা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যদি না ওই পুলিশ অফিসার একটি বিশেষ পদমর্যাদার অধিকারী না হন কিংবা অতি অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতিতে তিনি সেটা করে থাকেন। ভুলারের ক্ষেত্রে যদি অপর একজন বিচারক ভিন্নমত পোষণ করতেন তাহলে তিনি খালাসই পেতেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত সংশোধনের সামান্যই সুযোগ থাকে। তাই বিচারপতি শাহ যে পয়েন্ট উত্থাপন করেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সেটা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন করে মার্সি পিটিশন দেওয়া হলে তিনি সেটাকে পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। এটা একজনের জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন। এখানে সিদ্ধান্ত সংশোধন করার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: রাজিব গান্ধী হত্যা মামলার ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এমন একটি বেঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা ছিল আপনার জন্য একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। আপনি কি এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন?
উত্তর: আমি এখানে এর একটি ব্যাখ্যা দিতে আগ্রহী। রাজিব গান্ধী হত্যা মামলাসহ অন্য আরো যেসব মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেসব বেঞ্চে সম্পৃক্ত থাকাটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। আমি সে সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। কেননা একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তবে আইন মান্যকারী একজন নাগরিক হিসেবে এবং সুপৃম কোর্টের একজন বিচারক হিসেবে আমি বহু আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। কেননা সুপৃম কোর্টের বিচারক হিসেবে আমি যে শপথ নিয়েছি সে অনুযায়ী আমি তা করতে বাধ্য।
প্রশ্ন: আপনি আরো বলেছেন, রাজিব গান্ধী হত্যা মামলার আসামিকে ফাসি দেওয়াটা সংবিধান পরিপন্থী …।
উত্তর: ২০ বছর জেল খাটা মানে একটা লোকের প্রায় দুইবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করা। এত দীর্ঘ সময় কারোভোগ করার অর্থ কারা অন্তরালে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া। অতএব, এত বছর কারা অন্তরালে কাটানোর পর কাউকে ফাসি দেওয়াটা অসাংবিধানিক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিকল্প সাজা দেওয়া উচিত। বিকল্পটি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ফৌজদারি কারাবিধি (CrPC) ৪৩৩(এ) ধারার অধীনে একটা বিধান আছে যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো দণ্ড হ্রাস বা লাঘব করতে পারেন। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, যারা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তাদের ক্ষেত্রে এ ধারাটা প্রয়োগ কেন করা হয়। আমি আবারও বলছি, শাস্তি হতে হবে সংশোধনধর্মী।
চাকরি আগে, মতামত পরে
বাংলাদেশে অনেকেই আশা করবেন বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইনডিয়ান বিচারপতি টমাসের ইন্টারভিউয়ের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। বিচারপতি টমাস অবশ্যই প্রশংসিত হবেন, অবশেষে, তার প্রকৃত মতামত প্রকাশ করায়। তাকে সমালোচনাও করতে হবে এই কারণে যে, এর আগে তিনি মৃত্যুদণ্ডবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও মানুষের প্রাণ বাচানোর চেয়ে নিজের চাকরি বাচানোতেই আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি চাকরি জীবনে পদত্যাগ করেননি অথবা পদে থেকে ব্যক্তিগত মতামতটি প্রকাশ করেননি। ফলে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে কার্যকর- ন্যায়দণ্ড হয়েছে উপেক্ষিত।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একটি ফেডারাল রাষ্ট্র যেখানে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য নিজ নিজ আইনে চলে। তাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কিছু অঙ্গরাজ্যে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়েছে এবং কিছু অঙ্গরাজ্যে এখনো মৃত্যুদণ্ড বলবৎ আছে। তবে এর বিরুদ্ধে আমেরিকায় জনমত ক্রমেই প্রবল হচ্ছে।
চায়নাতে পাইকারিভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। এ বিসয়ে স্ট্যাটিসটিকস গোপন রাখা হতো। কিন্তু গত কয়েক মাসে জানা গেছে চায়নাও মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।