হ্যাকারদের ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এতে ব্যাংক খাতে ডিজিটাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীতে গড়ে উঠেছে কার্ড জালিয়াতির একাধিক প্রতারক চক্র। এরা সুকৌশলে বিভিন্ন নামিদামি শপিং মল, সুপারশপে চাকরি নিয়ে গ্রাহকদের কার্ডের বিভিন্ন তথ্য চুরি করছে। এমনকি এটিএম বুথে সূক্ষ্ম ডিভাইস বসিয়েও তথ্য চুরি করছে এই প্রতারক চক্র। পরবর্তীতে ক্লোন কার্ড তৈরি করে চুরি করা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বুথ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্লোন কার্ড ব্যবহার করে শপিংও করা হচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মাত্র কয়েকদিন আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার শরিফুল ইসলাম মিঠু নামের প্রতারকের কাছ থেকে অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের দেড় হাজার ক্লোন কার্ড উদ্ধার করেছে সিআইডি। মিঠু প্রায় অর্ধশত গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই মিঠুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে এমন আরও একাধিক চক্রকেও চিহ্নিত করে নজরদারিতে রেখেছে সিআইডি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি প্রযুক্তিগত। ফলে ব্যাংকগুলো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন ক্লোন কার্ড তৈরি করতে না পারে। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আরও সচেতন হতে হবে। কেননা কার্ড যত্রতত্র ব্যবহার করা যাবে না। কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে পিন নম্বর প্রবেশ করানোর সময় আরও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে পাশ থেকে কেউ দেখে না ফেলে। কিংবা গোপন কোনো ডিভাইসে যেন তা ধরা না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হুসেইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে যেতেই হবে। কিন্তু এ বিষয় ঝুঁকি আছে। তবে ব্যাংকের কার্ড হোল্ডারদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কার্ড জালিয়াতি করার ঘটনা ঘটলেও গ্রাহকরা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কার্ড বা পাসওয়ার্ড কারও হাতে না পড়লে কখনো ক্লোন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কার্ড ব্যবহারের ঝুঁকিগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। সুপারশপে পিওএস (পজ) মেশিনে বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এ জন্য পিওএস মেশিনের ব্যবহারের অনুমতিতে ব্যাংকের আরও বেশি কঠোর হওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন সারা পৃথিবীতে চিপস বেজড কার্ড ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা আছে চিপস বেজড কার্ড তৈরি করার। বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক এর ব্যবহার শুরু করেছে। তবে সবাইকে এটা করতে হবে। বর্তমানে যে কার্ড ব্যবহার হচ্ছে সেটা ক্লোন করা যায়। কিন্তু চিপস বেজড কার্ড ক্লোন করা যায় না। এটা নতুন প্রযুক্তি। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে নতুন বিনিয়োগ করতে হবে। এভাবে কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে সবার মধ্যে শঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। চিপস বেজড কার্ড হলে এ ধরনের জালিয়াতি ঘটবে না। পাশাপাশি কার্ডের ব্যবহারকারীদেরও সচেতন হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ ক্রেডিট কার্ড বাজারে রয়েছে। আর ডেবিট কার্ড রয়েছে ৮০ লাখেরও বেশি। দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৯টি ব্যাংকই কার্ড সেবা দিচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ড রয়েছে দেশীয় বেসরকারি মালিকানাধীন দি সিটি ব্যাংকের। ব্যাংকটির প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এর আগে বছর তিনেক আগে কার্ড ক্লোন করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার সময় ঢাকায় এক চীনা নাগরিককে আটক করা হয়েছিল। তার সঙ্গে আরও অন্তত দুজন চীনা নাগরিক জড়িত বলে তখন পুলিশ জানিয়েছিল। তারও আগে আরেক জালিয়াতির পর এক ইউরোপীয়কে আটক করা হয়। তখন কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তারও এ কাজে জড়িত থাকার বিষয় বেরিয়ে এসেছিল। তাদের কাছ থেকে গত কয়েক বছরে অন্তত এক লাখ ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়েছে। পরে কার্ড ক্লোন করা হয়েছে। প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং খাত বর্তমানে ডিজিটাল ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে একদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হবে, অন্যদিকে বিভিন্ন বুথে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।