পরনে দামি শাড়ি, গলাসহ শরীরে জড়ানো স্বর্ণের গহনা। কপালে এক চিলতে লাল সিঁদূর পরা এক রূপসী রমণী। চেহারা বা পোশাকে কোথাও দারিদ্র্যের ছাপ নেই। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে দাবি জানালেন, ভিক্ষা দেবেন ?
এমন প্রশ্নে সবাই বিস্মিত ও অবাক। স্বয়ং প্রতিষ্ঠান মালিক একজন ব্রাহ্মণ হলেও অবিশ্বাস্য ভেবে তার কাছে জানতে চাইলো কী বললেন, সুশ্রী সম্ভ্রান্ত ওই রমণী ভিক্ষার আবেদনটি পুনর্ব্যক্ত করলেন।
এতে ব্রাহ্মণ দোকানদারের বোধগম্য হওয়ায় সে কিছু না বললেও দর্শক হিসাবে কৌতূহল তৈরি হলো এই প্রতিনিধির। নানা প্রশ্নে বেরিয়ে এলো ভিক্ষা রহস্য। স্বপ্নাদেশে সমাজ সংসারের মঙ্গল কামনায় সাত গ্রামের ভিক্ষার অর্থে দেবীর পূজা অর্চনা করবেন তিনি। তাই নিজের সংসারের মঙ্গলার্থে স্বামীকে না জানিয়ে দূর গ্রামে ভিক্ষা করতে এসেছেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ওই রমণী।
পরে জানা গেল ওই রমণীর ন্যায় নাটোর শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে চলছে এমন ভিক্ষার অর্থে পূজা অর্চনা। স্বপ্নাদেশে ভিক্ষা করে দেবী মনসার পূজায় মেতেছেন নাটোরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
মাসাধিক কাল ধরে শহরসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্তও চলছে এই দেবীর পায়ে অর্ঘ অর্চনা। তারা জানান, মনসা দেবী এক ভক্তকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন যারা এ স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী তার পূজা অর্চনা করবেন তাদের পরিবারের মঙ্গল হবে। আর যারা এটাকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করবেন না তাদের অমঙ্গল হবে। তবে কাকে মনসাদেবী স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সে কথা জানেন না কেউই।
এমনই এক ভিক্ষুক নাটোরের বাসিন্দা জোৎস্না রানী। এক সময় ছিলেন মঞ্চ অভিনেত্রী। জীবনের দূরন্ত বয়সের নানা কাজে অনুতপ্ত তিনি সংসারের মঙ্গল কামনায় শেষ বয়সে প্রভুর ভক্তিতেই কিছুটা সময় দিতে চান। তাই এই স্বপ্নাদেশের কথা শুনে অন্যদের মতো তিনিই বের হন ভিক্ষা করতে। আশে পাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন চাল ও নগদ অর্থ। তার মতো তার এলাকার আরো অনেকের যোগার করা অর্থে এলাকার মন্দিরে করেছেন দেবী মনসার পূজা।
এমনই একটি বড়পূজার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে শহরতলী দিঘাপতিয়ার পাগলী কালীর মন্দিরে। এখানে পূজারীদের মাঝে বিতরণ করা আতব চালের ভাত ও পাঁচ তরকারির মধ্যান্ন ভোজ। এছাড়া ছিল প্রসাদেরও ব্যবস্থা। দিনব্যাপী চলে এই পূজার্চনা।
এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জানান, তারা লোক মুখে প্রচার হওয়া সংবাদ শুনে বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করে মনসা দেবীর সন্তুষ্টির জন্য এ পূজা করছেন। পরিবারের মঙ্গলের জন্য একত্রিত হয়ে ভিক্ষা করে এ পূজা করছেন তারা।
নাটোর শহরের লালবাজারস্থ জয়কালী বাড়ি প্রাঙ্গণেও দু’দিন ব্যাপী এমনই এক পূজার আয়োজন করা হয়। মনসা দেবীর মূর্তি বানিয়ে শত শত ধর্মপ্রাণ নারী তাদের ভিক্ষালদ্ধ চাউল ও টাকা দিয়ে এ উপলক্ষে শনি ও রোববার সকাল থেকে মনসাদেবীর পূজার আয়োজন করেন।
পূজা শেষে তারা ভিক্ষালদ্ধ চাউল ও অন্যান্য সব্জির সমন্বয়ে রান্না সম্পন্ন করে ভোগরাগের পর সেখানে উপস্থিত সবার খাবার ব্যবস্থা করেছেন। বিকেল তিনটা থেকে রাত পর্যন্ত চলবে মনসার গান।
রোববার সন্ধ্যায় শহরে বের করা হবে বিসর্জন শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রা শেষে মনসা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। এর আগে কানাইখালী, কাপুড়িয়াপট্টি, আলাইপুর, কান্দিভিটুয়া সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে সে সব এলাকার নারীরা এ পূজা সম্পন্ন করেন।
এ বিষয়ে জয়কালী বাড়ি পূজা আয়োজকরা জানান, তারা মুখে মুখে প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে তাদের এবং তাদের পরিবারের সবার মঙ্গল কামনায় এ পূজার আয়োজন করেছেন।
পূজার পুরোহিত সুনীল চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, কেউ স্বপ্ন দেখেছে কি দেখেনি সেটা কোন বিষয় নয়। কোন যুক্তি থাক বা না থাক পূজা করলে কোন অমঙ্গল নেই, তাই তারা যে কোন সময় এ পূজার আয়োজন করতে পারেন। এক সঙ্গে সবাই একস্থানে মিলিত হয়ে ভেদাভেদ ভুলে পূজা আয়োজন পূজা আয়োজন, এটাও কি বড় প্রাপ্তি নয়?