ঢাকা ফাঁকা

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

f06a28974eebe3ea05df38fbbde24e98-5ae95ab585b42

ঢাকা: সাত সকালে ঘর থেকে বাইরে পা দিয়েই অবাক নগরবাসী। হকারের হাঁকডাক নেই, কর্মমুখর মানুষের বেগবান স্রোত নেই, ছোট-বড় যানগুলোর ব্যগ্রতা নেই, নেই বিকিকিনির মানুষের মুখরতা। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। কলরব হারিয়ে ঘুমিয়ে আছে যেন ঢাকা!

আজকের ঢাকার এই শান্ত-নিঝুম রূপ সচরাচর দেখা যায় না। মে দিবসের ছুটির আড়মোড়া ভাঙার আগেই শবে বরাতের ছুটি। ছুটি আর ছুটি মিলে ঢাকার এই অনন্য রূপ।

শহরের কথা উঠলে একটি জনসমুদ্র চলে আসে/ রাস্তা মানেই অবারিত নদী/ গণ মানুষের জোয়ার ভাটার টানে ব্যস্ততা আর…
নগর জীবনে যাঁদের বাস, শিরোনামহীন ব্যান্ডের এই গানের অর্থ তারা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন। মানুষের স্রোতে শহরটির দিকে কখনো পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো হয় না। সকাল সন্ধ্যায় সবার গন্তব্যে ছোটার তাড়া শহরটির রাস্তায় জনস্রোত বইয়ে দেয়। এটাই চেনা শহর। দিনের আলোয় ঘুমিয়ে থাকা শহরটিকে তাই অচেনা লাগে অনেকের কাছে।

আজ বুধবার ফাঁকা ঢাকার অলস চেহারা অনেককেই দিয়েছে শান্তি। দুই ঈদ ছাড়া ঢাকার এমন চেহারা কখনো দেখা যায় না।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোমিনুল হক জানালেন, কলাবাগানে তাঁর বোনের বাসার উদ্দেশে বেরিয়ে ছিলেন। কাওরানবাজার থেকে সেখানে গাড়িতে পৌঁছাতে তাঁর আট-নয় মিনিট সময় লেগেছে। তিনি বলেন, অন্যদিন এমনটা কল্পনাই করা যায় না। এত যানজট থাকে যে, এই পথটুকু অন্য সময় পাড়ি দিতে ৪০-৪৫ মিনিট, কখনোবা আরও বেশি সময় লাগে।

মিরপুর ১০ থেকে মোটরসাইকেলে করে ২০ মিনিটে মতিঝিল পৌঁছেছেন বলে জানালেন মাহবুব হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টায় রওনা দিই। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে এসে অবাক হয়ে যাই। অন্য সময় যানজটের এখানেই অনেক সময় নষ্ট হয়। আজ মুহূর্তেই যেন পার হয়ে গেলাম এ দূরত্ব।’

মাহবুব বলেন, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলায় এই এলাকায় অনেক যানজট হয়। এ ছাড়া পথে পথে যানজটে আটকে থাকতে থাকতে অন্য সময় মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।

সরকারি ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে বাড়তি ছুটি নগরটিকে হঠাৎ করেই নিরিবিলি করে দিয়েছে। ২৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত দুই দিন ছাড়া সপ্তাহ জুড়ে ছুটির ফাঁদে পড়েছিল শহর। গত ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার চাকরিজীবীদের অনেকে অফিস শেষে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। কারণ পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার (২৭ ও ২৮ এপ্রিল) সাপ্তাহিক ছুটি। ২৯ এপ্রিল রোববার ছিল বুদ্ধপূর্ণিমার সরকারি ছুটি। পরদিন ৩০ এপ্রিল সোমবার অনেকে একদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন।
গতকাল ১ মে মঙ্গলবার মহান মে দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি ছিল। আজ ২ মে বুধবার শবে বরাতের সরকারি ছুটি রয়েছে। কাল ৩ মে বৃহস্পতিবার ছুটি না থাকলেও পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কথা মাথায় রেখে কেউ কেউ বৃহস্পতিবারও ছুটি নিয়েছেন। অনেকে এভাবেই টানা নয় দিনের ছুটি বানিয়েছেন। পরিবার নিয়ে লম্বা ছুটি কাটাতে অনেকে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। ফাঁকা সড়ক সে কথাই বলছে।
গতকাল মঙ্গলবার ছিল পবিত্র শবে বরাতের রাত। মুসল্লিরা রাতভর নামাজ আদায় করেছেন। ফজরের নামাজ শেষে অনেকেই হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছেন, কেউবা হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। অনেকে আবার পরিবারের সঙ্গে ছুটির দিনটি ঘরেই কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাই ব্যস্ত শহর ঢাকায় নেই কোনো কোলাহল। আজ সকাল থেকেই রাজধানীর রাজপথে নেই যানজট।

তেজগাঁও মহিলা কলেজের সামনে এ সপ্তাহে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক কনস্টেবল শামীম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গতকালও ঢাকা বেশ ফাঁকা ছিল। আজ গতকালেরও চেয়েও রাস্তা বেশি ফাঁকা। অন্য সময় এখানে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কারণ সকালবেলায় চাকরিজীবী ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের কারণে এই এলাকায় যানজট থাকে। আজ কোনো যানজট নেই।
শামীম বলেন, ‘যানজট সামলাতে ব্যস্ত থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এমন ফাঁকা দেখলে অস্বাভাবিক লাগে। মনে হচ্ছে যেন আমার কোনো কাজ নেই।’
একই কথা বললেন কাওরানবাজার এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক কনস্টেবল আনিছ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘রুটিন মাফিক ভোর ছয়টার সময় এখানে এসেছি। কিন্ত কাজের কোনো চাপ নেই।’

শবে বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় দোকানপাটও ছিল বন্ধ। শেওড়াপাড়া, ঢাকা। ২ মে। ছবি: আবদুস সালাম
শবে বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় দোকানপাটও ছিল বন্ধ। শেওড়াপাড়া, ঢাকা। ২ মে। ছবি: আবদুস সালাম

কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁওয়ে রোকেয়া সরণিও একই রকম ফাঁকা। গত এক বছর ধরে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলার কারণে এখানে যানবাহনের গতি থাকে মন্থর। মেট্রোরেল প্রকল্পে ট্রাফিকম্যান সেলিম হোসেন বলেন, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকেই যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ থাকে। কিন্তু আজ এর কিছুই নেই। নয়টার পর কিছু মানুষ বের হয়েছে।

ঢাকা ফাঁকা থাকায় আয় বেশ কমে গেছে রিকশা চালক মনির হোসেনের। আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে এক যাত্রীকে নিয়ে ধানমন্ডি থেকে শেওড়াপাড়ায় আসেন তিনি। যাত্রী নামিয়ে খালি রিকশা চালিয়ে ফিরে যেতে হয় তাঁকে। মনির হোসেন বলেন, ‘শবে বরাতের জন্য রাইতে নামাজ পড়ছে। এর জন্য যাত্রী পাই নাই।’

বিজয় সরণি মোড়, ফার্মগেটে, শাহবাগ, কাকরাইলসহ বেশ কিছু ব্যস্ত সড়কে ট্রাফিক পুলিশের কাজ চলছে বেশ ঢিলেঢালাভাবে। চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে ট্রাফিক কনস্টেবল নূরুল ইসলাম বলেন, কদিন ধরে রাস্তায় গাড়ি কম চলছে। অনেকে ছুটির কারণে ঢাকা ছেড়েছেন। কাল রাতে নামাজ পড়েও বহু মানুষ আজ গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। তাই রাস্তা ফাঁকা।

ফার্মগেটের সামনে ট্রাফিক কনস্টেবল আবদুর রাজ্জাককে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘অন্য দিন হলে রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দৌড়াইতে হইত। আজকে মানুষ আর গাড়ি কিছুই নাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *