হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বারবার পায়ের কাটা স্থানে হাত দিয়ে পা খুঁজছেন রাসেল সরকার। হাতটা পায়ের কাছে নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ডাক্তার রাসেলকে বিশ্রাম নিতে বলছেন। কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু যুতটুক সময় জেগে থাকে, ততক্ষণই কাঁন্না করতে থাকে। তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনরা। এদিকে এ ঘটনায় বিচার পাওয়অ নিয়েও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন রাসেলের পরিবার। তাদের অভিযোগ, এটি দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছা করে গ্রিনলাইনের চালক কবির হোসেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অথচ পুলিশ দায়সারা মামলা নিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির যে ধারায় চালক অপরাধ করেছেন, সেই ধারায় মামলা নেয়নি। এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যার চেষ্টা মামলা হওয়া উচিত ছিলো। শুধু দুর্ঘটনাজনিত ধারায় মামলা হওয়ায় চালক কবির পার পেয়ে যাবেন। তাই বিচার পাওয়া নিয়ে শংশয় প্রকাশ করেছেন রাসেলের বড় ভাই আরিফ সরকার।
গত শনিবার বিকেলে কেরানীগঞ্জের এপিআর এনার্জি বিদ্যুৎ প্রজেক্টের একটি নির্মাণাধীণ স্থান থেকে ফেরার পথে দোলাইপাড়ে রাসেল সরকারের প্রাইভেট কারকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয় গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্টো ব-১৪-২৭৮৬)। তখন রাসেল গাড়ি থামিয়ে বাসের সামনে গিয়ে বাসচালককে নামতে বলেন। কিন্তু উল্টো বাস চালানো শুরু করেন তাতেই চাপা পড়ে পা বিচ্ছিন্ন হয় রাসেলের।
ঘটনার দিন ঢাকা মেডিক্যালে আহত রাসেল জানিয়েছিলেন, ধোলাইপাড় হানিফ ফ্লাইওভার ঢালে প্রাইভেটকারটি পৌঁছলে পিছন দিক থেকে যাত্রীবাহী গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস প্রাইভেটকারটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। তখন তিনি নেমে ধাক্কা দেয়ার কারণ জানতে চান চালকের কাছে। বিষয়টি নিয়ে বাসের চালক ও রাসেলের মধ্যে কথা কাটিকাটি হয়। একপর্যায়ে বাসের এক কর্মচারী রাসেলকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেন। এ সময় চালক বাসটি পায়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেন। এতে বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন প্রাইভেটকার চালক রাসেল।
এরপর তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হয়। সেখান থেকে স্কায়ার এরপর অ্যাপোলোতে ভর্তি করা হয়। জানা গেছে, বাসটি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুই মোটরসাইকেল আরোহী পিছু নিয়ে হাইকোর্টের পাশে কদম ফোয়ারার সামনে থেকে পুলিশের সহযোগিতায় আটক করে। এরপর বাস ও তার চালককে শাহবাগ থানা পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। ওই রাতে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলায় রাতে বাস চালক কবিরকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরের দিন গত রোববার কবির হোসেনকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম রিমান্ড নামঞ্জুর করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তিনদিন জেলগেটে কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।
গত রোববার অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসকরা রাসেলের পা জোড়া লাগাতে অস্ত্রোপচার করে। কিন্তু চার ঘণ্টার চেষ্টাও তা পা জোড়া লাগাতে পারেনি। চিকিৎসকরা রাসেলকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন ও তার সাথে স্বজনদেরও কথা বলতে বাড়ন করেছেন বলে জানিয়েছে রাসেলের পরিবারের সদস্যরা।
পা হারানো রাসেলের ভাই আরিফ সরকার জানান, ঘুমের মধ্যেও মাঝে মধ্যে আতখা চিৎকার দিয়ে উঠে রাসেল। যতটুক সময় জাগনা থাকে, ততক্ষণই হাউমাউ করে কাঁন্না করতে থাকে। আর বলে, আমার পা নেই। এখন আমার-স্ত্রী-সন্তানের কি হবে, ওদের কে দেখবে?। কিভাবে চলবো আমি। এসব কথা বলে আর বিলাপ করতে থাকে। তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষাও খুঁজে পান না বড় ভাই আরিফ।
আরিফ সরকার বলেন, ঘটনার সময় আশপাশের সবাই দেখেছেন, ধোলাইপাড়ে কীভাবে প্রাইভেটকার থামানো অবস্থায় ইচ্ছা করেই রাসেলের পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি তুলে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল গ্রিন লাইনের চালক। তবে পুলিশ দুর্বল ধারায় মামলা নিল। বারবার অনুরোধ করার পরও মামলার ধারায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানাব। অনেক মানুষের সামনে দিন দুপুরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রকৃত তথ্য আড়াল করে মামলা হলে কীভাবে ন্যায়বিচার পাব আমরা।
জানা গেছে, গোলাইপাড়ে ওই ঘটনায় ফৌজদারি কার্যবিধির ২৭৯ ও ৩৩৮/ক ধারায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করা হয়েছে। ওই মামলার একমাত্র আসামি গ্রিনলাইনের চালক কবির হোসেন। রাসেলের পা হারানো ঘটনায় শুধু বাস চালকই নয়, সুপারভাইজারও দায়ী বলে মনে করেন রাসেলের পরিবার।
রাসেলের ভাই আরিফ সরকার বলেন, বাস চালক কবিরকে আদালত জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে। তাকে রিমান্ডে আনা হয়নি। তিনি ক্ষোভে প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, কিসের জোরে কবির মিয়া আইনের ছাড় পাচ্ছে। আমার ভাইয়ের পা হারিয়ে গেছে, আদালত তাকে রিমান্ডের অনুমতি দিলেন না। এখন আমরা বুঝতে পারছি না এর বিচার পাব কি না। তাহলে আইন কি গরিবের জন্য নয়, বলে প্রশ্ন তুলেন আরিফ সরকার।