ঢাকা:গাজীপুর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের আছে ৩২০ জনের একটি দল। এই দলের সদস্যরা গাজীপুরের বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন ট্রাফিক সহকারী’ নামে পরিচিত। তাঁদের প্রত্যেকের ন্যূনতম বেতন ১০ হাজার টাকা। মাথাপিছু বেতন ধরলে তাঁদের সবার মাসিক বেতন হয় ৩২ লাখ টাকা। যদিও জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, এই সড়ক-পরিসেবায় তাঁর প্রতি মাসে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকার বেশি।
জাহাঙ্গীর বলছিলেন, গত চার মাসে দুই কোটি টাকার ওপর তাঁর খরচ হয়েছে। তাঁর ভাষ্য অনুসারে এক বছর এই সেবা চালু রাখলে তাঁর খরচ হবে ৬ কোটি টাকা। কিন্তু নির্বাচনের হলফনামায় এই ফাউন্ডেশনের কথা উল্লেখ করেননি জাহাঙ্গীর আলম। এমনকি বিপুল এই অর্থ কোথা থেকে দিচ্ছেন, কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে সম্পর্কে হলফনামায় কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি। অবশ্য তাঁর দাবি, এই অর্থ তিনি দান করেছেন। তাই উল্লেখ করেননি।
জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের অধীনে কেবল ‘ট্রাফিক সহকারী’ রয়েছেন তা–ই নয়। এই ফাউন্ডেশনের আওতায় এখন পর্যন্ত ২২ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছেন তিনি। জাহাঙ্গীর বলেছেন, এ বছর ১০ কোটি টাকার বৃত্তি দিয়েছেন। এ ছাড়া ১০০টি ল্যাপটপ দিয়েছেন, নিজ খরচে বিদেশে পর্যন্ত পাঠিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থীকে। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি থাকলেও ৫৭টি ওয়ার্ড কমিটি-শূন্য। এসব ওয়ার্ডে সক্রিয় জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন। দলীয় লোক, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, নারী—এই চার ক্যাটাগরিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীরের নিজস্ব একটি কমিটি আছে। অনেকেই এদের ‘জাহাঙ্গীর লীগের’ সদস্য বলে থাকেন। এসব পরিচালনা করতে খরচ হয় কোটি টাকা। এসবের কোনো তথ্য হলফনামায় নেই।
অর্থাৎ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ট্রাফিক সহকারী ও বৃত্তি বাবদ খরচ করেছেন প্রায় ১২ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও কয়েক কোটি টাকা ফাউন্ডেশন থেকে ব্যয় করা হয়েছে।
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের জমা দেওয়া হলফনামা প্রকাশের পর থেকে গাজীপুরে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও এই ব্যাপারে সরব হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমের এই ফাউন্ডেশনের বিষয়টি ওই এলাকার সবারই জানা। এ কারণে তাঁর প্রতিপক্ষরা বলছেন, হলফনামায় ওই তথ্য না থাকা নির্বাচনী আইন ভঙ্গের শামিল।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা দেখেছি। আমরা নির্বাচন কমিশনকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।’
ফাউন্ডেশনের আয়-ব্যয়ের তথ্যে গড়মিল নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এগুলো আমি দান করছি। তাই হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি।’ এসব ব্যয়ের অর্থ তিনি পারিবারিকভাবে পান বলেও জানান। তিনি দাবি করেন, ১৮ বছর ধরে নানা ধরনের দান ও সহায়তামূলক কাজ করছেন।
হলফনামা অনুযায়ী জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে ১ হাজার ৫৩৬ শতাংশ জমি। এর মধ্যে কৃষিজমি ১ হাজার ৪৯৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, অকৃষি জমি ৩৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। আবাসিক, বাণিজ্যিক জমি ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। জমি বিক্রির জন্য বায়না বাবদ নেওয়া ৮ কোটি টাকাকে ঋণ হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালে মেয়র পদে মনোনয়নপত্রে জমা দেন জাহাঙ্গীর আলম। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন। ওই সময় হলফনামা অনুযায়ী তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৯৫০ টাকা। বর্তমানে তাঁর বার্ষিক আয় ২ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ১ লাখ ৫০ হাজার, বাড়িভাড়া ৪ লাখ ৩০ হাজার, ব্যবসা থেকে ৯৪ লাখ ২০ হাজার ও অপ্রদর্শিত ১ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নগদ আছে ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ব্যাংকে তাঁর ব্যবসার পুঁজি জমা আছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭১ টাকা। ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৭ টাকা। সঞ্চয়পত্র আছে ১০ লাখ টাকার। এ ছাড়া তাঁর দুটি গাড়ি, একটি বন্দুক, একটি পিস্তল আছে।
জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ওই প্রার্থীর ব্যয়ের হিসাবের অসামঞ্জস্যের ব্যাপারে কেউ সুস্পষ্ট তথ্য দিলে বা অভিযোগ করলে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
তথ্যসূত্র প্রথম আলো