গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে বৈধ ৯ জন মেয়র প্রার্থীদের সবাই শিক্ষিত ও ধনাঢ্য। এদের মধ্যে অধিকাংশরাই ব্যবসায়ী। মেয়রপদের প্রার্থীদের মধ্যে অর্থ সম্পদের দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় আওয়ামীলীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বেশ এগিয়ে আছেন। উভয় প্রার্থীই ব্যবসায়ী।
তবে আয়ের ক্ষেত্রে এ দু’প্রার্থীর ক্ষেত্রে বেশ ব্যবধান রয়েছে। আয় ও সম্পদের দিক দিয়ে মেয়র পদের অন্য প্রার্থীদের তুলনায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বেশ এগিয়ে আছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। তাদের দু’জনেরই রয়েছে দায়দেনা। এছাড়া বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে দুটি মামলা চলমান রয়েছে। অপরদিকে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীর নামে অতীতে মামলা থাকলেও বর্তমানে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। আগামী ১ মে এ সিটি কর্পোরেশনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনে মেয়র পদের প্রার্থীদের হলফনামা থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা এমএ (স্নাতকোত্তর)। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনবিদ্যায় এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এছাড়াও তার রয়েছে ১ হাজার ৪৯৫.১৫ শতাংশ কৃষিজমি, ৩৩ দশমিক ৭১ শতাংশ অকৃষি জমি এবং ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ আবাসিক/বাণিজ্যিক জমি। তার রয়েছে একটি বন্দুক ও একটি পিস্তল এবং দুটি গাড়িসহ আসবাবপত্র ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী। তার বার্ষিক আয় ২ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এছাড়া কৃষি খাত থেকে তার বার্ষিক আয় দেড় লাখ টাকা এবং বাড়ি ও দোকান ভাড়া ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে আয় ৯৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে জমি বিক্রয়ের জন্য বায়না বাবদ ৮ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে তার। হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয়ের মধ্যে মধ্যে ১ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ই ধারায় অর্জিত দেখিয়েছেন।
তিনি নির্বাচনী প্রচার ও অন্য কার্যক্রমে কর্মীদের পেছনে ১০ লাখ টাকাসহ মোট ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করবেন বলে কমিশনকে জানিয়েছেন। এরমধ্যে তিনি নির্বাচনী প্রচারে ১ লাখ ১৪ হাজার পোস্টার ছাপাবেন এবং ১০ লাখ লিফলেট বিতরণ করবেন। এছাড়াও তিনি ১০টি নির্বাচনী ও একটি কেন্দ্রীয় ক্যাম্প স্থাপন ও ৫৭টি পথসভা করবেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। অতীতে তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়েছিল। মামলা দু’টির একটিতে তিনি খালাস এবং অপরটি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
হলফনামায় জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেছেন তার পেশা ব্যবসা। তিনি অনারেবল টেক্সটাইলস কম্পোজিট এবং জেড আলম অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অনারেবল টেক্সটাইলস কম্পোজিটে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং জেড আলম অ্যাপারেলসে ২০ হাজার টাকা তার শেয়ার রয়েছে। তার সম্পদের মধ্যে নগদ টাকার পরিমাণ ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা রয়েছে। ব্যাংকে জমা আছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭১ টাকা এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৭ টাকা। এছাড়াও তার ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে।
অপরদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার হলফনামায় একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর তুলনায় বিএনপি প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ অনেক কম হলেও বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ও তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া দু’জনই সম্পদশালী। হাসান উদ্দিন সরকার হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ১০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং তার ওপর যারা নির্ভরশীল, তাদের বার্ষিক আয় ৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। নিজের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৬৪ লাখ টাকা ও স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ ১৯ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন।
এর বাইরে দু’জনের ৫৩ তোলা স্বর্ণ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র রয়েছে। এছাড়া হাসান সরকার তার নিজের নামে একটি পিস্তল ও একটি শর্টগান এবং স্ত্রীর নামে একনলা বন্দুক রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। স্থাবর সম্পদের মধ্যে হাসান সরকারের নামে ৫৯৮ শতাংশ ও তার স্ত্রীর নামে ৩০৫ শতাংশ জমি রয়েছে। স্ত্রীর নামে রয়েছে চারতলা একটি বাড়ি। হাসান সরকারের ঋণ রয়েছে ২৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। হাসান উদ্দিন সরকারের বার্ষিক আয়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান ১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা।
এছাড়া কৃষি খাত থেকে ৬৩ হাজার, বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য ভাড়া ৫ লাখ ২২ হাজার ৯০০ টাকা, ব্যবসা থেকে ৩ লাখ ৭৩ হাজার এবং ব্যাংক সুদ বাবদ ১১ হাজার ৫২৬ টাকা আয় রয়েছে তার। তার বিরুদ্ধে ঢাকার তেজগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি ও টঙ্গী মডেল থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা চলমান রয়েছে। দুটি মামলার একটি বিচারাধীন ও আরেকটি তদন্তাধীন রয়েছে। এ দুটি মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে দায়ের করা হয়েছে। এর আগে ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছিল। এরমধ্যে দুটিতে বেকসুর খালাস ও একটি খারিজ হয়েছে।
হাসান সরকারের অস্থাবর সম্পদ রয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে তার নগদ রয়েছে টাকা সাড়ে ৩ লাখ টাকা ও ব্যাংকে জমা রয়েছে ৬০ লাখ ৪৯ হাজার ৬০১ টাকা। এছাড়াও তার রয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের একটি গাড়ি। তার ২১ তোলা স্বর্ণ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র রয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৫০০ দশমিক ৫৩১ শতাংশ কৃষিজমি, যার দাম দেখিয়েছেন ৯৪ হাজার ৪৬৪ টাকা রয়েছে তার । এছাড়াও তার ৭ দশমিক ৫ শতক জমিসহ ৫টি দোকান, ৯০ শতাংশ জমি ও স্থাপনা, টঙ্গীতে সেমিপাকা ৩২টি রুমের ঘর এবং একচালা টিনশেড রয়েছে। অপরদিকে হাসান উদ্দিন সরকারের স্ত্রীর সম্পদের মধ্যে নগদ ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা ৫৮ হাজার ৫৪২ টাকা রয়েছে। স্ত্রীর নামে ২৯০০ বর্গফুটের চারতলা বাড়ি রয়েছে; যার দাম ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ১৮৮ টাকা। এছাড়া ৩২ তোলা স্বর্ণ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আসবাবপত্র ও একনলা বন্দুক রয়েছে।
হাসান সরকার নির্বাচনে সম্ভাব্য ব্যয় ২০ লাখ টাকা করবেন বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা তার স্ত্রীর কাছ থেকে নেয়া হবে। নির্বাচনী প্রচারের পরিকল্পনায় তিনি ৩ লাখ পোস্টার এবং ৫ লাখ লিফলেট ও হ্যান্ডবিল ছাপাবেন ও বিতরণ করবেন। এছাড়াও তিনি দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প, একটি কেন্দ্রীয় ক্যাম্প স্থাপন করবেন, ১৭১টি পথসভা, ঘরোয়া বৈঠক ও সভা করবেন। তিনি ৩৪২টি ডিজিটাল ব্যানার এবং টেলিভিশন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণা করবেন।
ইসলামী ঐক্যজোট সমর্থিত প্রার্থী ফজলুর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা দাওরায়ে হাদিস। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। তার ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। তার বার্ষিক আয় ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ টাকা। এরমধ্যে তিনি ব্যবসা থেকে আড়াই লাখ টাকা, এজেন্সির পরিচালক হিসেবে সম্মানী ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল থেকে সম্মানী বাবদ ৭৫ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন। তার সম্পদের মধ্যে নগদ দুই লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৫ লাখ টাকা, একটি প্রাইভেট কার, আসবাবপত্র, ২৭ শতাংশ অকৃষি জমি ও নির্মাণাধীন বাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে কোন মামলা নেই এবং অতীতেও ছিল না।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) মনোনীত মেয়র প্রার্থী রাশেদুল হাসান রানার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। তার আয় ও সম্পদ দুটোই কম। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ টাকা। তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে ৫ বিঘা জমি রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন সমর্থিত প্রার্থী মো. নাসির উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা তাকমিল পাস। তিনি পেশায় শিক্ষক। তার বার্ষিক আয় সাড়ে ৮ লাখ টাকা। তার সম্পদের মধ্যে নগদ ৩৮ হাজার ২৮০ টাকা, ব্যাংকে জমা ৬ লাখ ২১ হাজার ৭২০ টাকা ও আসবাবপত্র এবং ১৬৫ শতাংশ অকৃষি জমি রয়েছে।
মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সানাউল্লার শিক্ষাগত যোগ্যতা কামিল পাস। তিনি পেশায় শিক্ষক। তার বার্ষিক আয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ টাকা। এছাড়া তার রয়েছে মোটর সাইকেল, স্বর্ণ ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র। তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে ১ বিঘা কৃষিজমি, ৪ বিঘা অকৃষি জমি ও একটি বাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা দুটি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়াও অতীতে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল। ওই মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী কাজী মো. রুহুল আমিন শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্নাতক পাস। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। তার বার্ষিক আয় ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা চলমান রয়েছে। আগে তিনটি মামলায় আসামি থাকলেও সেগুলো থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এমএ পাস। তিনি পেশায় চাকরিজীবী। তার বার্ষিক আয় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, সোয়া ২ কাঠা কৃষিজমি ও একটি বাড়ি। তবে তার কোনো দায়দেনা নেই। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, অতীতেও ছিল না।
এছাড়া অপর মেয়র প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিনও নির্বাচন কমিশনে তার হলফনামা দাখিল করেছেন বলে গাজীপুর নিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মন্ডল জানিয়েছেন। তিনি জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এবারের নির্বাচনে আইন অনুযায়ী মেয়র প্রার্থীগণের নির্বাচনী সর্বোচ্চ ব্যয় ৩০ লাখ টাকা ও প্রার্থীর ব্যক্তিগত ব্যয় দেড় লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।