আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায়…

Slider বিচিত্র

b4dc7fccfffbc551d51a32609b0da5e4-5ad090b3a4323

ঢাকা: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…। অদেখা সব নয়, কিছু দেখেছি, কিছু নয়। অপরূপ বাংলাদেশ। আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায় পাহাড়। সিলেট শহর থেকে উত্তরে যতই যেতে থাকি, আকাশের সাথে পাহাড়ের মিতালি ততই স্পষ্ট হতে থাকে। জৈন্তা-জাফলং। সবুজের কী অপূর্ব মেলা। জাফলং-এর পাথরময় ছোট্ট নদীর স্বচ্ছ পানিতে জলক্রীড়া উপভোগ করেছি বহুবার। এসব তরুণ বয়সের কথা। বর্ষায় পদ্মা-মেঘনার উত্তাল জলে স্টিমার ভ্রমণ, নৌকায় নদী থেকে সদ্য ধরা মাছের ঝোল ও মোটা চালের গরম ভাতের স্বাদ ভুলিনি এখনো। পতেঙ্গার সমুদ্র সৈকত, হাকালুকির বিশাল হাওর, লাউয়াছড়ার সবুজ অরণ্য, মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাত সবই দেখা। বন্যা বা বর্ষায় সুনামগঞ্জের হাওর যে দেখেনি, তার অনেক কিছুই অদেখা রয়ে গেছে। আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল সেনাবাহিনীর স্পিডবোটে পুরো বর্ষায় ওই হাওর দেখার। সুনামগঞ্জ-নেত্রকোণা জুড়ে হাওর আর হাওর। থৈ থৈ পানি আর পানি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। এ যেন সাগরের জলে ভাসছে সবুজ জাহাজ। জৈন্তা-জাফলং-এর সৌন্দর্যে অবগাহন করেছি বহুবার বহুদিন। সেলিব্রেটি লেখক-সাংবাদিকেরা সিলেট সফরে এলে তাঁদের সঙ্গে যেতে হতো। একবার শ্রীপুর-তামাবিল সীমান্তের দুর্গম অঞ্চল সফরের সুযোগ হয়েছিল, তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের সাথে, সাংবাদিক হিসেবে। সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আবিদের আমন্ত্রণে ওই সফরে অজানা শিহরণ অনুভব করেছি।
দেখা হয়নি কক্সবাজার, সুন্দরবন। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সেরা দুই গর্ব। ওই কষ্ট অনুভব করি এখনো। দু’বছর আগে আমার একমাত্র ছেলে বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিল কক্সবাজার। শুনে ভালো লেগেছিল। আমেরিকায় বড় হওয়া ছেলে কক্সবাজারকে মনে রেখেছে। কক্সবাজার সফরের সুযোগ পেয়ে যাওয়া হয়নি; এই আফসোস এখনো করি। আমার বড়ভাই আতাউর রহমান ছিলেন কক্সবাজার জেলার প্রথম এসপি। ওই সময় ভাবীর নিমন্ত্রণে পরিবারের অন্যরা বেড়াতে গেলেও পেশাগত ব্যস্ততায় আমার যাওয়া হয়নি। বড়ভাই আতাউর রহমান এখন আছেন আটলান্টায়। ক’দিন আগে ৯২তম জন্মদিন পালিত হলো তাঁর। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অপরূপ বাংলার যে ছবি মনে লালন করে এসেছি, তা অম্লান ছিল। অন্তত গত দু’দফা বাংলাদেশ সফরের আগ পর্যন্ত। প্রথম ধাক্কা খেলাম পরিবারের আগ্রহে জাফলং সফরে। একি দেখছি! সিলেট শহর থেকে বের হতেই চোখ ছানাবড়া। কোথায় সেই সবুজ পাহাড়। সীমান্তে পাহাড়ের যে বেষ্টনী, সেটা সবুজ নয়, ধূসর। চাঁদের কলঙ্কের মতো। যতই এগোচ্ছি, ততই স্পষ্ট হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধূসর ছাপ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওই দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কাছে গিয়ে দেখি, এখানে সেখানে পাহাড়ের গায়ে পাথর ভাঙার মেশিন। গড়-গড় শব্দ। গাছপালা নেই; কেটে উজাড়। আরও এগিয়ে দেখি, যে স্বচ্ছ জলে স্নান করতাম, সেই জল ময়লা ঘোলাটে। শত শত শ্রমিক পাথর সংগ্রহ ও তা স্তুপ করার কাজে ব্যস্ত। সারিবদ্ধ ট্রাক বোঝাই হচ্ছে পাথরে। ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত পুরো প্রান্তর জুড়ে। এই দৃশ্য দেখার জন্যই কি এখানে ছুটে এসেছি। ব্যথিত মনে ফিরে এলাম। দ্বিতীয়বার এ দৃশ্য দেখার ইচ্ছে রইল না। ভেবে পাইনি, প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সবুজ পাহাড়-প্রান্তর কী করে মানুষের হাতে বিরাণ প্রান্তরে পরিণত হলো?
এক ইঞ্চি জায়গা খালি না রেখে বহুতল ভবনে শহর ভরে যাওয়াকে যদি উন্নতি বলে, তবে ঠিকই উন্নতি হয়েছে। সিলেট শহরে হাঁটার জায়গা পাইনি। এক সময় ধোপাদীঘির উত্তর পার থেকে টিলাগড় এমসি কলেজে তিন মাইল হেঁটে আসা-যাওয়া করেছি। বাসা থেকে কর্মস্থল আম্বরখানার যুগভেরী অফিসে যাতায়াত করেছি হেঁটে। এবার ১০০ গজ হাঁটতে পারিনি। ফুটপাত নেই। যা আছে, তা বেদখল। খাল-ছড়া-ঝর্ণা বেষ্টিত সিলেট শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেম প্রাকৃতিকভাবেই গড়া। ওসব ভরাট। তিনটি বড় দীঘি; ধোপাদীঘি, লালদীঘি, সাগরদীঘি’র অস্তিত্ব নেই। শৈশবে ধোপাদীঘিতে সাঁতার কাটতাম। মনে পড়ে, সাঁতরিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের বাসার সামনে যেতাম। আবার ওখান থেকে উত্তরপারে নিজ বাসায় ফিরে আসতাম। ধোপাদীঘির পূর্বপাড়ে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর বাসা। পশ্চিমে জেল। এবার সুবিদবাজারে নিজহাতে গড়া প্রেসক্লাব চিনতে পারিনি। সারি সারি ভবনে ছেয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার মুক্ত জায়গা নেই।
পরিবেশের অনেক খবর পড়ি। চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে, আর সিলেটে পাথার চাপায় মৃত্যু, চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ও সিলেটে টিলা কাটা। ঢাকার যে দৃশ্য দেখেছি তাও বা কম কিসে। গুলশান লেকের কাছে আমার দুই অনুজের বাসা। বাড়ির ব্যালকনিতে বসে দেখেছি লেকের দু’পাশ থেকে অনবরত ‘গার্বেজ’ ছোড়া হচ্ছে। লেক হলো ডাম্পিং গ্রাউন্ড। এর জল এতটাই দূষিত, যার স্পর্শে রোগ-বালাই হতে পারে। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে একটি লেকের এমন করুণ দশা কর্তৃপক্ষের কী অজানা? শুনেছি, বুড়িগঙ্গার জলও নাকি ছোঁয়া যায় না। গুলশান-বারিধারায় সুন্দর সুন্দর দালানকোঠা। ভেতরে দামি আসবাব ও তৈজসপত্র বিদেশকেও হার মানায়। কিন্তু বাইরে হাঁটার জায়গা নেই। ছোট্ট রাস্তা। কোথাও ফুটপাত আছে, কোথাও নেই। রাস্তার পাশে ইট-পাথরসহ নানান নির্মাণ সামগ্রী। কোথাও ভাঙা, কোথাও গর্ত। চেয়ে দেখি, এই ঢাকা বৃক্ষহীন হয়ে বড় হচ্ছে। ষাটের দশকে ঢাকার যে সবুজ দেখেছি, এখন তা নেই। বৃক্ষহীন নগরী কী আমরা চেয়েছিলাম?
ওই ঢাকার একটি পার্ক দেখে মন জুড়ে যায়। বারিধারায় মসজিদের পাশে একটি ছোট্ট পার্ক। এত সুন্দর, সুসজ্জিত, সবুজ ঘাস ও ফুলে ফুলে সুশোভিত এমন পার্ক এই আমেরিকায়ও কম দেখেছি। মনে মনে ভাবলাম, চাইলে কী না হয়। একদিকে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব, আর অন্যদিকে এমন সবুজ-সনীল প্রান্তর গড়া- এ তো সবই মানুষের হাতে। পরিবেশ বাঁচতে পারে জনগণের সচেতনতায়। প্রার্থনা করি, সেই চেতনা গড়ে উঠুক।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *