চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এক দিকে কোটা আরেক দিকে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণসহ নানা ধরনের দুর্নীতি। কোথায় যাবে মেধাবীরা?
৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগের পর বাকি ৪৪ শতাংশ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পদে পদে চলছে অনিয়ম। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্যদের সেবা পাওয়া থেকে। বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার তরুণ যোগ্য মেধাবীরা। বছরের পর বছর ধরে চলা এ বঞ্চনা আর হতাশা রূপ নিয়েছে প্রচণ্ড ক্ষোভে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান শাসক শ্রেণীর নানা ধরনের বৈষম্য আর বঞ্চনা থেকে মুক্তিই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আজ কোটার নামে বৈষম্যের পাহাড় চড়িয়ে দেয়া হয়েছে জাতির মেধাবী তরুণ যুবকদের ওপর।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার কোটা সংস্কারের আন্দোলনের পর থেকে সর্বস্তর থেকে এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলা হচ্ছে মেধাবীদের বঞ্চিত করে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। এত কোটার কারণে ভবিষ্যতে দেশের প্রশাসন মেধাহীন হয়ে পড়বে এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের আমলারা বিপর্যস্ত অবস্থার মুখোমুখি হবেন দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং দরকষাকষির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ সব ক্ষেত্রে। অনেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার এবং অনগ্রসর যারা রয়েছেন তাদের সব ধরনের আর্থিক ও সেবামূলক সুবিধা দেয়া হোক। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যদের বাদ দিয়ে যেন অযোগ্যদের বসানো না হয়। তারপর প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোটায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের যারা চান্স পাচ্ছেন তাদের কত শতাংশ আসলে প্রকৃত মুুক্তিযোদ্ধা তা নিয়ে।
বার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর ইদানীং যেমন প্রকাশিত হচ্ছে তেমনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রিকশা চালানোর বা ভিক্ষা করার খবরও বের হচ্ছে পত্রপত্রিকায়।
কোটায় খেয়ে ফেলছে মেধাবীদের অধিকার। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ভালো রেজাল্ট করেও যোগ্য প্রার্থীরা চান্স পাচ্ছে না প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে। বিসিএস ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার পরীক্ষা দিয়েও তাদের ফিরে আসতে হয় ভগ্ন হৃদয়ে। তিন থেকে চারবার বিসিএস দিয়েও চান্স পায় না অনেকে। অন্য দিকে তাদের চেয়ে কম মেধা, কম যোগ্যতা এবং পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে মাত্র একবার পরীক্ষা দিয়েই চান্স পেয়ে যাচ্ছেন প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণ। এ দৃশ্য যেন মেধাবীদের হত্যার সমতুল্য।
একজন অভিভাবক আফসোস করে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও বিসিএসে চান্স না পাওয়া যে কত কষ্টের তা আপনাদের কী করে বোঝাবো। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে চান্স পাওয়া আসলে অনেক বড় চাকরি পাওয়ার চেয়েও কঠিন একটি কাজ। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফলের পরও অনেক অধ্যয়ন করতে হয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। তারপরও পাস করার পর যদি তাদের বেকারত্বের হতাশায় ভুগতে হয় আর তাদের সামনে বড় বড় সরকারি চাকরি পায় অযোগ্যরা, বিশেষ করে যাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ারই যোগ্যতা ছিল না তখন সে কষ্ট রাখার আর জায়গা থাকে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) বর্তমানে প্রতি ১০০ জনে ৫৬ জন চান্স পায় কোটার মাধ্যমে। বিসিএস ক্যাডার ছাড়াও প্রথম শ্রেণীর আরো সরকারি চাকরি রয়েছে। তারা নন ক্যাডার। প্রথম শ্রেণীর এই নন ক্যাডার এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতি বহাল রয়েছে। এর বাইরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটার হার আরো বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়।
৫৬ শতাংশ এই কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে।
কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষের জন্য ৩৬ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরি বরাদ্দ রয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বিলি করা প্রচারপত্রে তুলে ধরা তথ্যে বলা হয়েছে বর্তমানে দেশের ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিমাণ হলো ১ দশমিক ১০ শতাংশ। আর তাদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরি বরাদ্দ রয়েছে ৫ শতাংশ। দেশে প্রতিবন্ধী জনসংখ্যার হার ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ শতাংশ চাকরি। অন্য দিকে দেশের মোট জনসংখ্যার বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পোষ্যদের সংখ্যা হলো দশমিক ১৩ শতাংশ। আর তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ চাকরি। এভাবে দেশের মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ শতাংশ চাকরি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে মত ব্যক্ত করে চলেছেন সর্বস্তরের মানুষ। মেধার এত অবমূল্যায়ন কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। কোটার কারণে অনেকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ এবং বঞ্চিত মেধাবীদের কথা ভেবে।
শোষণ বৈষম্য দূর করে যার যার পাওনা তাকে তা পাইয়ে দেয়া, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য।
সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ২৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’
কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে সংবিধানের এ ধারা লঙ্ঘন হচ্ছে বলে তুলে ধরছেন অনেকে। তা ছাড়া সংবিধানে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য ৩-এর ‘ক’ ধারায় যে বিশেষ বিধানের কথা বলা হয়েছে তা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয় বলেও অনেকে উল্লেখ করেছেন।
১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালু হয়েছিল দেশের অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য। গত ৪৬ বছরে তারা অনেক অগ্রসর হয়েছেন। তাই আর নয় বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মতে বৈষম্য দূর করার জন্য চালু হয়েছিল কোটা কিন্তু এখন কোটা নিজেই বড় ধরনের বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে যেমন ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে তেমনি ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা রয়েছে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, নারী ১৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, আনসার ও ভিডিপি ১০ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১০ শতাংশ। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা ৬০ শতাংশ।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা মিলিয়ে প্রায় ৯৬ শতাংশই কোটা রয়েছে। রেলওয়েতে ৮২ শতাংশ কোটা রয়েছে এর মধ্যে ৪০ ভাগ পোষ্য কোটা যা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের প্রচারপত্রে।