সারা দেশে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কোন্দল প্রকট হওয়ায় দলে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অনেকটা বেশি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন না হলে আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। গ্রুপিংয়ের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর কাছে ভরাডুবি হয়েছে আওয়ামী লীগের। নির্বাচনের পরই সংশ্লিষ্ট নেতাদের পর্যবেক্ষণেও তা উঠে এসেছে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অঙ্গনে এভাবে পরাজয় কোনোভাবেই মানতে পারছে না ক্ষমতাসীনেরা। আগামী নির্বাচনের আগে এটাকেও বড় ধরনের বিপদ সঙ্কেত হিসেবে দেখছে দলটির হাইকমান্ড।
ইতোমধ্যে দলীয় কোন্দলের সঠিক কারণ চিহ্নিত করে তা নিরসনের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দিয়েছেন দলীয় প্রধান। ওই কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে আগামীকাল সোমবার প্রথম বৈঠক করবেন এবং সারা দেশে দলীয় কোন্দল নিরসনে করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কখনো এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে, কখনো ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে, আবার কখনো দলীয় পদ-পদবির লোভে প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীকেও খুন করতে পিছপা হচ্ছেন না প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা। আবার ঠিকাদারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং জমি দখলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করতে গিয়েও কখনো কখনো ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক নেতাকর্মী।
এ ছাড়াও স্থানীয় নির্বাচনে তৃণমূলকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালী ও অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় নন এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ায় একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। যার ফলে স্থানীয় নির্বাচনে অনেক উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরো পোক্ত হচ্ছে ওই সব এলাকায়। বিরোধী দলবিহীন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ নিজ দলের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
এ ছাড়া বেশকিছু আসনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অনেক নেতা। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে দল ক্ষমতায় আসার পরই বেপরোয়া হয়ে উঠে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জাতীয় নির্বাচনের পরপরই পাঁচ দফায় উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের প্রথম দফায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ৯৭টি উপজেলার মধ্যে ৬২টিতেই চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। এরমধ্যে ৫২টিতেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা শক্ত অবস্থানে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
দ্বিতীয় ধাপে ১১৭ উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৫৪ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শক্ত অবস্থানে ছিলেন। ওই নির্বাচনে মাত্র ৪৫টি চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। তৃতীয় ধাপে ৮৩টির মধ্যে ৪৮টি উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচন করেন। তৃতীয় ধাপে প্রশাসনের ওপর ভর করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপসহ পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন না হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের শক্ত অবস্থান বজায় ছিল। অনেক জায়গায় নিজেদের মধ্যে সংঘাত, মারামারি ও হানাহানির ঘটনাও ঘটে। দল টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও সম্প্র্রতি অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যাওয়া এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভরাডুবির পরই বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
গত শুক্রবার সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় বিষয়টি আলোচনায় আনেন নেতারা। পরের দিন কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ দলীয় কোন্দলের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এরপর পুরো বৈঠকে দলের বিভিন্ন স্তরে কোন্দল নিরসনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করেন উপস্থিত প্রায় সব নেতা। কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। একই সাথে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়ের বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন তারা।
এরপরই দলীয় প্রধান কাজী জাফরুল্লাহর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে আরো রয়েছেন- মাহবুব উল আলম হানিফ, ডা: দীপুমনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মো: আব্দুর রহমান। পরে অনুসন্ধান কমিটিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানসহ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণ তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ প্রধান। অপর দিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক সম্পাদকদেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কমিটি কাজ শুরু করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক এবং পরাজয়ের কারণ হিসেবে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করছে কমিটি। আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পরাজয়ের সঠিক কারণ ও করণীয় উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন দলীয় প্রধানের কাছে জমা দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া সারা দেশে দলীয় কোন্দলের কারণ অনুসন্ধানে আগামী ৯ এপ্রিল দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের সাথে বৈঠক করবে অনুসন্ধান কমিটি। ওই বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সবচেয়ে বেশি কোন্দলপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ওইসব এলাকার নেতাদের ঢাকায় তলব করা হবে এবং প্রয়োজনে বিরোধপূর্ণ এলাকা সফর করে তৃণমূল নেতাদের সাথে কথা বলে কোন্দল মীমাংসার চেষ্টা করা হবে। এরপরই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদন তৈরি করবেন বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয়েছে ১৫০টি। এতে ২৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২৪৬৬ নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগ-যুবলীগের মধ্যে তিনটি সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও ৪৩ জন আহত হন। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে ৭টি সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ৪৫ জন আহত হন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে সাতটি সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ৪৩ জন আহত হন। গত বছরে যুবলীগে ১১টি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ৫০ জন আহত হন। গত বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পাঁচজন নিহত এবং ২৪১ জন আহত হন। গত বছর সারা দেশে রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৫২ জন। এরমধ্যে ৪০ জনই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মী।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরমধ্যে শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই ৮৩ জন। আর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণহানি হয়েছে ১৫৩ জনের। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের মধ্যে সংঘাতে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। এর আগের বছর ২০১৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪৭। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় অস্থির হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। টানা দুইবার ক্ষমতায় আছে। এত বড় দলের তৃণমূল পর্যায়ে ছোটখাটো কিছু মতদ্বৈততা থাকতেই পারে। তবে আমাদের দলে কিছু স্বার্থান্বেষী অনুপ্রবেশ করেছে। কিছু ভুঁইফোড় সংগঠন দাঁড় করিয়েও কিছু অনুপ্রবেশকারী এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সে বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ নয়া দিগন্তকে বলেন, সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী হেরেছে। পরাজয়ের পেছনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন, আগামী ৯ তারিখ অনুসন্ধান কমিটির সাথে সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে কিভাবে বিভিন্নস্থানে দলের কোন্দল নিরসন করা যায় সেই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনজীবীদের নির্বাচনে প্রায় প্রতি বছরই এরকম অবস্থা হয়ে থাকে। সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এভাবে চলতে থাকবে। এ কারণেই দল বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছে। তিনি বলেন, কমিটি আমাদের ডেকেছিল। আমরা বিষয়টি পরিষ্কার করেছি। এ নিয়ে কমিটির বেশ কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে।