মন্দ ঋণের কবলে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ওই ঋণ কাক্সিক্ষত হারে আদায় হচ্ছে না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। আবার খেলাপি ঋণ আদায়ের হারও অনেক কম। বেশির ভাগ খেলাপি ঋণ আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোরই ঋণ প্রায় ৯১ শতাংশ। আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর মাস শেষে ছয় সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই ৩৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকা; যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে ৩৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই ২৪ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা; যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৩ শতাংশ।
শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ ৯ বিদেশী ব্যাংকের। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই দুই হাজার আট কোটি টাকা, যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি পরপর তিন মাস আদায় না হলে ওই ঋণকে নিম্নমানের ঋণ বলা হয়। আবার কোনো ঋণ পরপর ছয় মাস আদায় না হলে তাকে সন্দেহজনকে ঋণ বলা হয়। সন্দেহজনক ঋণ হলেই গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। আবার ওই ঋণ ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তাকে মন্দ ঋণ বলা হয়। মন্দ ঋণ হলেই টাকা আদায়ের জন্য মামলাসহ সবধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। সোনালী ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ দিন মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ দিকে নতুন করে আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে মন্দ ঋণ ও মামলার জট। ব্যাংকও মামলা পরিচালনা করতে অর্থ ব্যয় করে। এভাবে কোনো ঋণ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা হিসাবে রাখা হয়, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় ঋণ অবলোপন বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঋণ আদায় হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অনিয়ম, দুর্নীতি বেড়ে গেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে অর্থ ব্যয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ এবং লোকবল নিয়োগ করে ব্যাংকের ব্যয় বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে সরকারি ব্যাংকগুলোতেই মন্দ ঋণের পরিমাণ বেশি ছিল। সেই তুলনায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এই ধরনের ঋণ কম ছিল। কিন্তু এখন সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও মন্দ ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে ঋণ একবার খেলাপি হচ্ছে ওই ঋণ আর সহজেই আদায় হচ্ছে না। ফলে তাদের মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। কারণ মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকগুলোর আয় খাতের অর্থ থেকে। একই সাথে কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ সক্ষমতা। কারণ আমানতের অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। কম মুনাফায় আমানত নিয়ে বেশি মুনাফায় ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ আদায় না হলেও শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদে আসলে আমানতকারীকে টাকা পরিশোধ করতে হয়।
এখন অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ আদায় না হওয়ায় নতুন আমানতের অর্থ থেকে মেয়াদপূর্তির আমানত পরিশোধ করতে হচ্ছে। ঋণ আদায় হলে যেখানে ব্যাংকগুলো বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারত সেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সেই সাথে কমছে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা। ব্যাংকাররা জানান, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকগুলোকে কঠিন মূল্য দিতে হবে।