নারীদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা মহানবীর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল- ‘সিবিএস’ এর ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন। সৌদি নারীদের অবাধ স্বাধীনতা দেয়ার ব্যাপারে এই প্রথমবার জনসম্মুখে মুখ খুললেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ৩২ বছর বয়সী এই যুবরাজের সাক্ষাৎকার নেন উপস্থাপিকা নোরাহ ও’ডনেল। এসময় সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি, যুগের পর যুগ ধরে চলা আসা রাষ্ট্রীয় নানা নিয়মের পরিবর্তন, ইরানের সাথে সম্পর্ক এবং পরমাণু ইস্যুতে কথা বলেন যুবরাজ।
আদৌ কি সৌদি আরবের নারীরা পুরুষের সমান সম্মান পাবেন?- এই প্রশ্নের উত্তরে সালমান জানান- সবাই সৃষ্টিকর্তার তৈরি মানুষ, কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মহল নারী-পুরুষে ভেদাভেদ টেনেছে। তিনি আরও বলেন, ইসলাম ধর্মেই স্পষ্টভাবে নারীর পোশাক কি হবে, সেই বর্ণনা দেয়া আছে। তারজন্য, সমাজের আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন নেই।
তার সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ…
নোরাহ ও’ডনেল: অনেকের ধারণা, সৌদিতে যে ধরনের ইসলাম অনুশীলন করা হয় তা খুবই কঠোর এবং অসহনশীল। এটা কি সত্যি?
মোহাম্মদ বিন সালমান: ১৯৭৯ সালের পর থেকে এটিই আসলে সত্য। আমরা এর ভূক্তভোগী। বিশেষ করে আমার প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি এ বিষয়টি কারণে ভূগতে হয়েছে।
(১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব হয়। এরপর দেশটিতে ধর্মীয় শাসন জারি করা হয়। একই বছর কাবা শরিফ অবরোধ করে সৌদি আরবের ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা। তাদের শান্ত রাখতে এরপর সৌদি আরবকে ধীরে ধীরে কট্টরবাদী ধর্মীয় চর্চার দিকে নিয়ে যায়। এবং দৈনন্দিন জীবনে নারীদেরকে আলাদা করে ফেলা হয়। যুবরাজ বিন সালমান মূলত এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।)
নোরাহ ও’ডনেল: গত ৪০ বছরের সৌদি আরব যেমন ছিল, এটাই কি প্রকৃত সৌদি?
মোহাম্মদ বিন সালমান: অবশ্যই না। এটা প্রকৃত সৌদি আরব নয়। দর্শকদের (টিভি দর্শকদের উদ্দেশে) প্রতি আমার অনুরোধ তারা যেন প্রকৃত সৌদি আরবকে দেখতে নিজেদের স্মার্টফোনের একটু সহায়তা নেন। তারা গুগল করলেই জানতে পারবেন ৬০ বা ৭০ দশকের সৌদি আরব কেমন ছিল? ওই সময়কার কিছু ছবি দেখলে সহজেই বুঝতে পারবে প্রকৃত সৌদি আরব কেমন।
নোরাহ ও’ডনেল: তাহলে ১৯৭৯ এর আগের সৌদি কেমন ছিল?
মোহাম্মদ বিন সালমান: তখন আমরা উপসারগরীয় অন্যান্য দেশেগুলোর মতো খুবই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতাম। নারীরা গাড়ি চালাতে পারতো। দেশজুড়ে সিনেমা হল ছিল। নারীরা সবখানেই কাজ করতো। ৭৯ সালের ঘটনার আগ পর্যন্ত আমরা বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশের মতোই স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম।
নোরাহ ও’ডনেল: নারীরা কি পুরুষদের সমান?
মোহাম্মদ বিন সালমান: অবশ্যই। আমরা উভয়েই আদম সন্তান এবং আমাদের মধ্যে মানুষ হিসেবে কোনো পার্থক্য নেই।
নোরাহ ও’ডনেল: আপনি বলেছিলেন যে, আপনি ‘সৌদি আরবকে সেই মডারেট ইসলামে ফিরিয়ে নিতে চান যেখানে এটি ছিল।’ এটা দিয়ে আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন?
মোহাম্মদ বিন সালমান: আমাদের এখানে উগ্রপন্থিরা আছে যারা নারী-পুরুষদের মেলামেশায় বাধা দেয়। তারা আসলে দুইজন নারী-পুরুষের নির্জনে মিলিত হওয়া আর নারী-পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে একসাথে কাজ করার বিষয় দু’টিকে আলাদা করতে পারে না। (তাদের) এরকম অনেক চিন্তা মহানবী (স.) ও খলিফাদের সময়ের জীবন ধারার সাথে সাংঘর্ষিক। ওই জীবনাচরণই (ইসলামের) সত্যিকারের মডেল।
(যুবরাজ বিন সালমান দায়িত্ব নেয়ার পর সৌদি আরবের ‘ধর্মীয় পুলিশ’ এর ক্ষমতা কমিয়েছেন। এই পুলিশরা জনপরিসরে মুখ ঢেকে না চললে নারীদেরকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা রাখতো।)
মোহাম্মদ বিন সালমান: আইন খুবই স্পষ্ট, এবং তা শরিয়া আইনেই আছে যে, নারীরা পরুষের মতোই শালীন কাপড় পরবে। এর মানে এটা নয়, শুধুই কালো রঙের আবায়া বা কালো হিজাব পরতে হবে। কোন ধরনের শালীন ও সম্মানজক কাপড় সে পরবে এটা নারীদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
বিন সালমানের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সিবিএস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তার কথাগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখন পর্যন্ত সেদেশের ধর্মীয় নেতারা চুপ করে আছেন, এবং এই তরুণ যুবরাজের কাছে আনুগত্যের শপথ করেছেন।’
প্রসঙ্গত, অনেক বিশ্লেষকের ধারণা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর সৌদি আরব যে কট্টরপন্থার দিকে যায় তার কারণ ইরানি বিপ্লবের রাজতন্ত্রবিরোধী চেতনা। যা দেখে ভয় পেয়ে যায় সৌদি রাজবংশ। এবং সৌদি আরবেও যাতে রাজতন্ত্রবিরোধী কোনো ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ধারণার প্রসার না ঘটে সেজন্যই সৌদি রাজতন্ত্র আরো ধর্মীয় কট্টরপন্থা অবলম্বন করে।
সূত্র: সিবিএস নিউজ