নেপালের ১২ জন ট্রাভেল এজেন্সি মালিক বাংলাদেশে এসেছিলেন একটি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে তারা ইউএস-বাংলার ওই বিমানে করেই দেশে ফিরেন। তাদের মধ্যে তিনজন নিহত ও ৯ জন আহত হয়েছেন। আহতদের একজন আশিষ রঞ্জিত। নরভিক ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান’। এ সময় তার স্বজন ও শুভাকাক্সীরা তার বিছানার চার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন রঞ্জিত বেঁচে যাওয়ায়। রঞ্জিতের ভাই এ সময় আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, যখন বিমান দুর্ঘটনার খবর শুনি তখন বলতে গেলে আমাদের কোন হুঁশ ছিল না, এখন অনেক ভালো লাগছে।
রঞ্জিত বলেন, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম। কারণ বিমানটি দুলছিল। আমি আতঙ্কিত হয়ে একজন বিমানবালাকে ডাকলাম। কিন্তু আমাকে তার সিটে বসেই আঙুলের সঙ্কেতের মাধ্যমে আমাকে নির্ভয়ে বসে থাকতে বললেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বিমানের গতি বেড়ে গেল এবং আমি বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। আমার জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হলেও আমি সম্বিত ফিরে পেলাম এবং চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম বিমানে আগুন জ্বলছে। লোকজন কান্নাকাটি করছেন এবং কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। আমি দ্রুত আমার সিটবেল্ট খুলে ফেললাম এবং আমার কয়েকজন বন্ধুসহ বিমান থেকে লাফ দিয়ে বাইরে চলে এলাম। এভাবেই আমরা বেঁচে গেছি। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়ই এটা সম্ভব হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা না বাঁচালে অন্যদের সাথে আমিও মারা যেতাম।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের আরেকজন হলেন ২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশী শিক শাহরিন আহমেদ। কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ টিচিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। কান্নাভেজা চোখে শাহরিন সংবাদমাধ্যম বলেন, আমি আমার বন্ধুর সাথে বিমানে ছিলাম। বিমানটি যখন অবতরণ করার সময় এটি বাম দিকে মোড় নিতে শুরু করে। এ সময় যাত্রীরা চিৎকার করতে লাগলেন। আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বিমানে আগুন ধরে গেছে। আমার বন্ধু আমাকে বলল তার আগে আগে দৌড়াতে। কিন্তু যখন আমরা দৌড়াতে লাগলাম আগুনের শিখা তাকে ঘিরে ফেলল। ও পড়ে গেল। লোকজন আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল, চিৎকার করছিল আর পড়ে যাচ্ছিল। তিনজন জ্বলন্ত বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ল। খুব ভয়াবহ ছিল এ দৃশ্য। ভাগ্যক্রমে কেউ একজন আমাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসে। শাহরিন বলেন, বাইরে প্রচণ্ড রকমের আগুন ছিল এবং আমাদের কেবিন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এরপর সেখানে একটি বিস্ফোরণ হয়। পরে আগুন নিভিয়ে উদ্ধার করা হয় আমাদের।
চিকিৎসক নাজির খান জানান, শাহরিন ডান পায়ে আঘাত পেয়েছেন। তার সার্জারি করতে হবে। পিঠও ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।
শাহরীন আহমেদ আরো বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা থেকে আমরা টেক অফ করি। আড়াইটার দিকে কাঠমান্ডু পৌঁছে পাইলট প্রথমে ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। পরে ঘুরে ঘুরে আবার যখন দ্বিতীয়বার ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন, বাম দিকটা উঁচু হয়ে যায়। তখনি আমি বললাম, বাম দিকটা উঁচু হলো কেন, আর তখনি ক্রাশ হয়ে গেল।
একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, এরকম সতর্কবার্তাও পাইলট, কেবিন ক্রু বা অন্য কেউ দেননি। তারা নিজেরাও কিছু বুঝতে পারেননি। সবাই ভয়ে চিৎকার করছিল আর আল্লাহর কাছে দোয়া পড়ছিল।
এর আগে কি আপনাদের কোনো আভাস দেয়া হয়েছিল? আপনারা কিছু টের পেয়েছিলেন? জবাবে শাহরীন আহমেদ বলেন, একেবারে স্বাভাবিকভাবেই বিমানটি নামছিল। একদম হঠাৎ করে সব কিছু হয়ে গেল। ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় তিনি কাঁদছিলেন আর বার বার কেঁপে উঠছিলেন।
পেশায় শিক শাহরীন আহমেদ একজন বন্ধুর সঙ্গে প্রথমবারের মতো নেপাল বেড়াতে এসেছিলেন। কাঠমান্ডু ও পোঁখরায় বেড়ানো শেষে শুক্রবারই তাদের ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই বন্ধু দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
শাহরীন বলেন, আগুন লাগার প্রায় ২০ মিনিট পর সাহায্য আসে। সে পর্যন্ত আমি ও আরেকজন বিমানের ভেতরেই বসেছিলাম। প্রচণ্ড ভয় লাগছিল আর হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলাম। কারণ আমি জানতাম, আগুন লাগার পর অনেকে দম বন্ধ হয়েই মারা যায়। উদ্ধারকারীরা আগুন নেভানোর পর বিমানের একটি অংশ খুলে যায় আর বাইরে থেকে পরিষ্কার বাতাস ভেতরে আসতে শুরু করে। বাইরে আসার সময় তিনি দেখতে পান, আরেকজন কাছেই বিমানের ফোরে পড়ে ছিল, তার হাত ঝুলছিল। তিনি বেঁচে আছেন কি না, শাহরীনের তা জানা নেই।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আরেক বাংলাদেশী মেহেদি হাসান। প্রথমবারের মতো বিমান ভ্রমণ করছিলেন তিনি। তার স্ত্রী, এক আত্মীয় এবং ওই আত্মীয়ের মেয়ে সঙ্গে ছিল। মেহেদি বলেন, আমার সিটটি ছিল বিমানের পেছন দিকে। আগুন দেখেই আমি আমার পরিবারের লোকজনের অবস্থা জানার চেষ্টা করলাম। জানালা ভাঙার চেষ্টা করলাম। আমরা অপোয় রইলাম যে, কেউ আমাদের উদ্ধার করতে আসে কি না। আমি ও আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু আমার কাজিন ও তার মেয়ে নিখোঁজ।
কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড টিচিং হাসপাতালটিতে শাহরীন ও মেহেদিসহ ১২ আহতের চিকিৎসা চলছে। অপর চারজনকে এ হাসপাতালে আনা হলেও পরে তাদেরকে গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, নিউরো এবং নেপাল মেডিসিটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কেশব পান্ডে নামে আহত এক নেপালি নাগরিক জানান, বিমান দুর্ঘটনার পর আগুন লাগার কথা। কিন্তু কিভাবে বিমান থেকে বের হয়ে এলেন তা মনে করতে পারছেন না তিনি। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর আমি বিমান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। কারণ বিমানটিতে আগুন ধরে গিয়েছিল, কিন্তু বের হতে পারছিলাম না। আমার হাত-পা আটকে গিয়েছিল। আমি জরুরি বহির্গমন দরজার পাশের একটি সিটে বসেছিলাম। সম্ভবত উদ্ধারকারীরা দরজা খোলার পর আমি বাইরে পড়ে যাই। এরপর আর কিছু মনে নেই।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আরেক নেপালি সানম শাকিয়া বিধ্বস্ত বিমানের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানান, মাটি স্পর্শ না করা পর্যন্ত বিমানটিতে কোনো ঝামেলা হচ্ছে বলে তিনি বুঝতে পারেননি। বিমানটি উপর-নিচ, ডান-বাম আবার উপর-নিচ করছিল। সে কারণে আমি ভাবলাম এটি বিমান চলাচলসংক্রান্ত কিছু। কিন্তু বিমানটির যে সমস্যা আছে সেটা কেবল জোরপূর্বক অবতরণের পরই বুঝতে পারলাম।
ওই বিমান দুর্ঘটনায় আহত নেপালি বসন্ত বহরা বর্তমানে থাপাথালিভিত্তিক নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। বসন্ত জানান, ঢাকা থেকে উড্ডয়নের সময় স্বাভাবিক ছিল বিমানটি। কিন্তু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময়ই সঙ্কট তৈরি হয়।
বিশ্বনেতাদের শোক : নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তারা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে তারা এ শোক প্রকাশ করেন।
নেতাদের মধ্যে রয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব, দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি সেইন লুং, কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ও বাংলাদেশে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের(ইইউ) রাষ্ট্রদূতরা শোক জানিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন ইইউ ডেলিগেশন, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ইটালি, সুইডেন, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের মিশন প্রধানরা। শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে টেলিফোন করে দুর্ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করেন।
ময়নাতদন্তের জন্য লাশ হাসপাতালে : কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ৪৯ জনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য গতকাল দেশটির মহারাজগঞ্জে অবস্থিত ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালে আনা হয়েছে। নেপাল পুলিশের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে লাশগুলো সংগ্রহ করে এই হাসপাতালে আনা হয়।
নেপালের তদন্ত কমিটি গঠন : ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নেপাল সরকার ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। বিমান দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় এ তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
তদন্ত কমিশনের ছয় সদস্য হলেন, যজ্ঞ প্রসাদ গৌতম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা: রাজীব দেব, ক্যাপ্টেন কে কে শর্মা, সুনীল প্রধান এবং উদ্ধব প্রসাদ সুবেদী, বুদ্ধি সাগর লামিছানে। সাবেক সচিব যজ্ঞ প্রসাদ গৌতম এই কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন। গতকাল মঙ্গলবার থেকেই এই কমিশন তদন্ত শুরু করেছে।
ত্রিভুবন নিয়ন্ত্রণ করে ৬ কর্মকর্তা বদলি : নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কে সে সময় দায়িত্বে থাকা ছয় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
দেশটির ইংরেজি নিউজ পোর্টাল মাই রিপাবলিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনা প্রত্য করার ধাক্কা ‘সামলে ওঠার সুযোগ দিতে’ বিমানবন্দর কর্তৃপ এ ব্যবস্থা নিয়েছে।
নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপরে উপ-মহাপরিচালক রাজন পোঁখারেল বলেছেন, এমন দুর্ঘটনার পর মানসিক চাপ লাঘবের এটাই প্রচলিত নিয়ম।
কাঠমান্ডু থেকে যেভাবে লাশ ঢাকায় আনা হবে : নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন তাদের স্বজনেরা। আগুনে পুড়ে লাশগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ায় শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে নিহত বাংলাদেশীদের লাশ ঢাকায় আনা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো জানায়, শনাক্ত করার পর লাশগুলো ইউএস-বাংলা নিজ খরচে ঢাকা নিয়ে আসবে। তবে ঢাকায় পাঠানোর সময় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, কাঠমান্ডু পুলিশের রিপোর্ট ও দূতাবাসের রিপোর্টÑ এই তিনটি কাগজ অবশ্যই লাগবে। তবে এসব রিপোর্ট পেতে কোনো সমস্যা হবে না। নেপাল ও বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।