শোকে স্তব্ধ বাংলাদেশ

Slider গ্রাম বাংলা

1-121

 

ঢাকা: পাহাড় সমান শোকে শোকাকুল গোটা দেশ। কাঁদছে মানুষ। শোকে কাতর হিমালয় কন্যা নেপালও। একসঙ্গে অর্ধ শতাধিক মানুষের স্বপ্ন পুড়ে গেছে এক বিমান দুর্ঘটনায়। সারা জীবন চাকরি করে অবসর অবকাশে বের হয়ে ছিলেন দুই দম্পতি। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন কেউ কেউ।

মা-বাবার সঙ্গে দীর্ঘ ছুটি কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নেপালি শিক্ষার্থীরা। তাদের সবার স্বপ্ন জেট ফুয়েলের আগুনে পুড়েছে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫০ জন। নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনের মৃত্যুর খবর আসলেও কেউ কেউ এখন আশায় বুক বেঁধে আছেন তার প্রিয়জন হয়তো বেঁচে আছে। এমন আশা আর চোখে জল নিয়ে গতকাল যাত্রীদের অনেক স্বজন নেপাল গেছেন। তাদের কেউ গেছেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বজনদের দেখতে, কেউ গেছেন প্রিয়জনের লাশ নিয়ে আসতে। সেখানে যাওয়া স্বজনদের কয়েকজন জানিয়েছেন তারা তখন পর্যন্ত জানেন না তাদের স্বজন বেঁচে আছেন নাকি বেঁচে নেই। শোকাতুর এসব পরিবার আর স্বজনদের সঙ্গে শোকে কাঁদছে পুরো দেশের মানুষ। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। এ পরিস্থিতির কারণে সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে গতকালই দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ৫০ জনের মধ্যে বিমানের পাইলট-কো পাইলটসহ ২৬ জন বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকালে সর্বশেষ সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে আরো ১০ বাংলাদেশি কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এদিকে বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামালসহ সিভিল এভিয়েশন ও ইউএস-বাংলার কর্মকর্তারা গতকাল নেপাল গেছেন। এছাড়া ইউএস- বাংলার অন্য একটি ফ্লাইটে বিধ্বস্ত বিমানের যাত্রীদের স্বজনদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাঠমান্ডুতে। প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর জেনে কেউ গেছেন লাশ আনতে। কেউ গেছেন আহত স্বজনের পাশে থাকতে।
এদিকে দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে নেপাল কর্তৃপক্ষ। বিশ্লেষণ করা হচ্ছে ব্ল্যাক বক্সের তথ্য। দুর্ঘটনার পেছনে কন্ট্রোল টাওয়ারের কর্মকর্তাদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার অভিযোগের মধ্যেই গতকাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ৬ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা চোখে দেখা কর্মকর্তাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেই তাদের বদলি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে চালু হওয়ার পর অন্তত ৭০টি দুর্ঘটনা ঘটে পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরের অন্যতম ত্রিভুবনে। এতে সাড়ে ছয়শ’র বেশি মানুষ প্রাণ হারান। সোমবারের দুর্ঘটনায় ইউএস-বাংলার বিমানের পাইলট আবিদ সুলতানকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এদিকে দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করার ঘোষণা দিয়েছে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ। নিহতদের লাশও দেশে আনার ব্যবস্থা করবে তারা। এছাড়া নিহত ও আহতদের বীমা সুবিধা এবং ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও জানিয়েছে বিমান সংস্থাটি। এদিকে নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার কথা জানিয়েছে। নিহতদের লাশ ফিরিয়ে আনা ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নেপালের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাওয়া হয়েছে দূতাবাসের পক্ষ থেকে।
পাইলটও মারা গেছেন: মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনার পরও প্রাণে বেঁচেছিলেন পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান। প্রায় ২০ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন তিনি। গতকাল সকাল ১০টার দিকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কাছে হার মানেন। বেসামরিক বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার একজন দক্ষ পাইলট ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ছিলেন প্রশিক্ষকও। ইউএস-বাংলার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম গতকাল দুপুরে বারিধারার কার্যালয়ে সাংবাদিককে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ইউএস-বাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের ১০ই মে ইউএস-বাংলায় যোগ দেন ক্যাপ্টেন আবিদ। নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি তিনি শিক্ষানবিশ পাইলটদের প্রশিক্ষণও প্রদান করতেন। এই সংস্থায় ৫ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন তিনি। বিমানটির উড্ডয়নের আগে প্রকৌশলীর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি। আবার নেপালের ওই ত্রিভুবন বিমানবন্দরটি অন্যান্য সাধারণ বিমানবন্দরের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর তালিকায় রয়েছে এর নাম। তাই ওই বিমানবন্দরে অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য পাইলটদের আলাদা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। আবিদ সুলতানের সেই প্রশিক্ষণ ছিল। সেই সঙ্গে ওই বিমানবন্দরে শতাধিকবার ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা ছিল তার। এ অবস্থায় তার কোনো ভুলের জন্য এই দুর্ঘটনার সম্ভাবনার কথা মানতে নারাজ ইউএস-বাংলার কর্মকর্তারা। তাদের দাবি ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অবতরণকালের শেষ মুহূর্তে বিভ্রান্তিকর একাধিক নির্দেশনা দেয়ার কারণেই এমন দুর্ঘটনা। এছাড়া বিমানের তথ্যসম্ভারের ব্ল্যাকবক্সটি যেহেতু উদ্ধার হয়েছে তাতে উঠে আসা তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের দাবিও জানিয়েছেন তারা। বিমানের ফার্স্ট অফিসার পৃথুলা রশিদ, কেবিন ক্রু খাজা হুসেইন মোহাম্মদ শাফী এবং শারমিন আক্তার মারা গেছেন বলেও নিশ্চিত করেন ইউএস বাংলার কর্মকর্তা।

বিশ্ব নেতাদের শোক: কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় তাদের পরিবারের প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন মিশন শোক জানিয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওই জোটভুক্ত দেশগুলোর আবাসিক মিশনের প্রধানরা নিহতদের পরিবারের পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের জন্য শোক প্রকাশ করেন। শোক প্রকাশকারী দূতরা হলেন- ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি রেনজি তিরিংক, স্পেনের রাষ্ট্রদূত আলভারো ডি সালাস জিমিনেজ ডি আজকারেট, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি কুয়েলিনায়ের, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত চার্লট্টা স্লাইটার, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হেমনিতি উইনথার, বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক, জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. থমাস হেইনরিস প্রিঞ্জ এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি-এ্যানিক বারডিন। বিবৃতিতে এই দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের দ্রুত আরোগ্যও কামনা করা হয়। এদিকে এ দুর্ঘটনায় এক বার্তায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শোক প্রকাশ করেছেন। মস্কো থেকে পাঠানো ওই শোক বার্তায় দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনাও জানানো হয়েছে। এর আগে সোমবার রাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এ সময় সুষমা স্বরাজ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানভূতি ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি কাঠমান্ডুতে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেন এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকে দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য প্রার্থনা করেন। এছাড়াও ঢাকাস্থ কানাডা দূতাবাস নেপালের কাঠমান্ডুর বিমান দুর্ঘটনায় আলাদা বিবৃতিতে শোক জানিয়েছে।

সিঙ্গাপুরে সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার রাত ৭টা ৫০ মিনিটে নেপালের প্রধানমন্ত্রী খাগা প্রসাদ শর্মা অলিকে টেলিফোনে সেখানে সাহায্য পাঠানোর কথা বলেছেন। জবাবে শর্মা অলি জানিয়েছেন, তিনি দুর্ঘটনাকবলিত স্থান পরিদর্শন করেছেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সোমবার দুপুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ওই বিমানটি নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পাশের একটি খেলার মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলট, কো-পাইলট, ক্রুসহ ২৬ বাংলাদেশি মিলে মোট ৫০ জন নিহত হন। বিমানটিতে ৬৭ যাত্রীর মধ্যে বাংলাদেশি ৩২ জন, নেপালের ৩৩ জন এবং চীন ও মালদ্বীপের একজন করে যাত্রী ছিলেন। আর ক্রু ছিলেন ৪ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *