সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আটক যুবরাজ, শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের শারীরিক নির্যাতনের আরো ভয়ংকর খবর পাওয়া গেছে। নির্যাতনের মুখে এক সৌদি জেনারেলের মৃত্যু ঘটেছে, যাঁকে ঘাড় ভাঙা অবস্থায় ও শরীরে পোড়া ক্ষত দেখা গেছে। এ ছাড়া যারা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে, ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। তাদের গতিবিধি নজরে রাখার জন্য গোড়ালিতে অ্যাংকেল ব্রেসলেট হিসেবে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিং ডিভাইস।
গতকাল সোমবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে সৌদি কর্তৃপক্ষ গত রবিবার এক ফিরতি ই-মেইলে পত্রিকাটিকে বলেছে, ‘বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অসত্য। অ্যাটর্নি জেনারেলের অধীনে সৌদি আইন অনুযায়ী অভিযোগগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্ত সবাই আইনি সহায়তা এবং চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে।’
আগামী সপ্তাহে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে সামনে রেখে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করল নিউ ইয়র্ক টাইমস। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বলে আসছে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৌদি বাদশাহর উত্তরাধিকারী মুহাম্মদের নির্দেশেই গত নভেম্বরে ওই অভিযানটি চালানো হয়, যাতে সাবেক বাদশাহ আব্দুল্লাহর ছেলেদের ক্ষমতার বাইরে রাখা যায়।
গত বছরের নভেম্বরে সৌদি সরকার দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে ৩৮১ জন ব্যক্তিকে আটক করে। তাদের অনেকেই সৌদি রাজ পরিবারের সদস্য। আটক করার পর তাদের সৌদি আরবের বিলাসবহুল হোটেল রিয়াদ রিজ কার্লটনে বন্দি করা হয়। এর কিছুদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত সামরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকওয়াটারের কর্মীদের দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এই বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠে।
গতকাল নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে অনেক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মুক্ত নয়। তারা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত রাখা হয়েছে।
মার্কিন পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক মাস ধরে আটকাবস্থায় বন্দিদের ওপর নির্যাতন চলছে। এর মধ্যে ধরপাকড় অভিযান শুরুর দিনগুলোতে শারীরিক নির্যাতনের কারণে ১৭ জন বন্দিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এক চিকিৎসক ও মার্কিন কর্মকর্তার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। পরে তাদের একজন বন্দি অবস্থায়ই মারা যান। তিনি হলেন মেজর জেনারেল আলি আল-কাহতানি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউ ইয়র্ক টাইমসে বলেন, নিহত মেজর জেনারেল কাহতানির ঘাড় ভাঙা ছিল। তাঁর শরীর ফোলাসহ নির্যাতনের অনেক চিহ্ন ছিল। শরীরের কোনো কোনো স্থানে পোড়া দাগও গেছে, যা ইলেকট্রনিক শকের চিহ্ন।
অন্যদিকে মুক্তি পেয়ে যারা রিজ হোটেল ত্যাগ করেছে, তাদের শুধু বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে জরিমানা হিসেবে দিতেই হয়নি, একই সঙ্গে তাদের মহামূল্যবান রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও কম্পানিগুলোর শেয়ারও সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হয়েছে। কিন্তু মুক্তি পেয়েও তাদের এবং তাদের পরিবারগুলোকে এক ধরনের বন্দিজীবনই কাটাতে হচ্ছে।
পায়ে ট্র্যাকিং ডিভাইস (পর্যবেক্ষণ যন্ত্র) হিসেবে ইলেকট্রনিক অ্যাংকেল ব্রেসলেট পরা অবস্থায় দেখা গেছে সাবেক এক বন্দিকে, যিনি একসময় ব্যক্তিগত বিমানে চলাফেরা করতেন। এরই মধ্যে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামায় তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর পরিবারের এক সদস্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আমরা সব কিছুই (সম্পদ) হস্তান্তর করে দিয়েছি। এমনকি আমি যে বাড়িতে থাকি, আমি নিশ্চিত না, এটাও আদৌ আমার আছে কি না।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, সৌদি আরবের সাবেক বাদশাহ আব্দুল্লাহর ছেলেদের সম্পদ এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য। কারণ তাঁরাই সৌদি রাজমুকুটের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০১৫ সালে যখন সালমান বাদশাহ হন, তখন তিনি ও তাঁর ছেলে ক্রাউন্স প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান তাঁদের সাইডলাইনে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে আব্দুল্লাহর ছেলে যুবরাজ তুর্কিকে রিয়াদের গভর্নর পদ থেকে অব্যাহতি, আরেক ছেলে মুতাইবকে গত নভেম্বরে ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই দুজনই এবং তাঁদের অন্য ভাইদেরও গত নভেম্বরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আটক করা হয়।
সূত্রঃ নিউইয়র্ক টাইমস