মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদীই এখন মৃত। দীর্ঘ বাঁক নিয়ে জেলার এক পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা-যমুনার শাখা নদীগুলোই প্রবাহিত হয়েছে জেলার ভেতর দিয়ে। এর মধ্যে কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদী উল্লেখযোগ্য। এসব নদীতে শুধু বর্ষা মওসুমের তিন-চার মাস পানি থাকে। বছরের বাকি সময় নদীগুলো যেন মরুভূমি হয়ে পড়ে। বিশেষ করে চৈত্রের শুরুতে বেশির ভাগ নদীর শতকরা ৮০ ভাগ পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। মানিকগঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঙ্গার বুকে এখন ধুধু বালুচর। যতদূর চোখ যায় শুধু বালু আর বালু। যতটুকু পানি আছে তার ওপর দিয়ে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করতে হিমশিম খায়। লোকজন কাপড় না ভিজিয়েই অনায়াসে নদী পার হতে পারে। অথচ তিন দশক আগেও কালীগঙ্গায় ফেরি চলাচল করত। সময়ে-অসময়ে কূল উপচে পানি পৌঁছে যেত গৃহকোণে।
স্থানীয় অনেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, প্রচণ্ড ঢেউ, স্রোত ও ঝড় তুফানের জন্য মানুষ ছোটখাটো নৌকা নিয়ে নদী পারাপার হতে সাহস পেত না। মানুষ ও যানবাহন পারাপারের জন্য ছিল ফেরি, লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সমস্ত যানবাহন ও মানুষ দেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত করত কালীগঙ্গা নদী পার হয়ে। এই নদী পার হতে গিয়ে বড় বড় ঢেউ এসে নৌকাকে সজোরে ধাক্কা দিলে মানুষের বুকে কম্পন শুরু হয়ে যেত।
আশির দশকের শুরুতে তরায় কালীগঙ্গা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় বিশাল সেতু। সেতুটি নির্মাণের পর থেকেই ধীরে ধীরে কালীগঙ্গা নদী তার যৌবন হারাতে থাকে। বর্তমানে কালীগঙ্গা নদীর এক পাশে খালের মতো হাঁটু পানির আঁকাবাঁকা লাইন চলে গেছে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো জেলায়। আর এই কালীগঙ্গা নদীকে পুঁজি করে প্রভাবশালীদের মাটি ও বালু কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা জমে উঠেছে। সেই সাথে নদীর সরু পথে যেটুকু পানি রয়েছে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ফলে কালীগঙ্গা তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমি ভেঙে যাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় জানান, কালীগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীরও একই অবস্থা। এক সময় ধলেশ্বরী নদী পানিতে ভরপুর থাকত। এখন এ নদীতে পানির দেখা মেলা ভার। নদী শুকিয়ে ফসলের মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে। মানিকগঞ্জের জাগির ব্রিজের নিচে গেলেই দেখা যায় ধলেশ্বরীর মরা কান্না। মাইলকে মাইল শুধু ফসলের মাঠ।
কয়েকটি শিল্প-কারখানার বর্জ্যরে পানিই হচ্ছে এখন কালীগঙ্গার পানি। বিষাক্ত পানিতে সাপও থাকতে ভয় পায়। কালীগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী আর ইছামতি নদীরও একই হাল। পদ্মা নদীর শাখা ইছামতি নদী এখন অনেকটা পানিশূন্য। হরিরামপুর উপজেলার ইছামতি নদী দিয়ে এক সময় ঐতিহ্যবাহী ঝিটকা হাটের সমস্ত পণ্য নৌকাযোগে আনানেয়া করা হলেও এখন সে অবস্থা নেই। বর্ষা মওসুম ছাড়া সারা বছর নদীতে পানি থাকে না। তিন-চার মাস নৌকার কদর থাকলেও বছরের বাকি সময় নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায় পানির অভাবে।