মালদ্বীপে সংকটের শুরু ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে। দেশটির আদালত ও সরকারের সাংঘর্ষিক অবস্থানের কার্যত অবসান হয় জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার এর মেয়াদ বাড়ানো হয় এক মাস। প্রথমে রাখঢাক করে প্রতিক্রিয়া জানালেও এবার ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ ঘটনায় তারা ‘বেশ আতঙ্কিত’। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যে পদ্ধতিতে মালদ্বীপের মজলিশ (পার্লামেন্ট) জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি অনুমোদন করেছে, তা সংবিধানসম্মত নয়। এটি উদ্বেগের বিষয়।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, শাসক দলের ৩৮ জন আইনপ্রণেতার সমর্থনে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে। তবে মজলিশের ওই সভায় অংশ নেননি বিরোধী দলের সদস্যরা। তাঁদের অভিযোগ, জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমোদনের জন্য ৪৩ জন আইনপ্রণেতার ভোট প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ভোট দিয়েছেন ৩৮ জন।
ভারতের বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে মালদ্বীপও। গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বীপদেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মালদ্বীপের ‘বর্তমান পরিস্থিতি ও ঘটনার বাস্তবতাকে’ উপেক্ষা করছে। একই সঙ্গে বর্তমান সংকট সমাধানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়—এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে ভারতসহ অন্যান্য মিত্র দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। সর্বোচ্চ আদালত ও সরকারের মধ্যে মতান্তরের শুরু ১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এক আদেশে মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্ট সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় নয়জন রাজনৈতিক বন্দীকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেন। এসব রাজনৈতিক বন্দীর বিরুদ্ধে করা মামলাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দেন আদালত। বহিষ্কৃত ১২ জন আইনপ্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার আদেশও দেওয়া হয়। এটি মানা হলে দেশটির ৮৫ সদস্যের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো।
তবে আদালতের আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন সরকার। অভিযোগ উঠেছিল, প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের চেষ্টায় আছেন সুপ্রিম কোর্ট। আর জরুরি অবস্থা জারির পর ভোজবাজির মতো পাল্টে যায় পাশার দান। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে আটক করা হয় প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ সাঈদসহ দুই বিচারপতিকে। গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকেও। এরপরই রায় পাল্টে ফেলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির আদেশও প্রত্যাহার করা হয়।
মালদ্বীপের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে ভারতও। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রভিশ কুমার গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘মালদ্বীপের সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হোক। একই সঙ্গে দেশটিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক এবং প্রধান বিচারপতিকে মুক্তি দিয়ে আদালতের স্বাধীন কার্যক্রম চালাতে দিতে হবে।’
ভারত কী চায়?
চীনের একটি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, চীনের নৌবাহিনীর কিছু যুদ্ধজাহাজ এরই মধ্যে মালদ্বীপের দিকে রওনা হয়েছে। এই খবর ফলাও করে প্রচার করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র ক্যাপ্টেন ডিকে শর্মা বলেছেন, খুব সূক্ষ্মভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ভারত এবং ভারত মহাসাগরজুড়ে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেক বিশ্লেষক মালদ্বীপের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। লাইভ মিন্টে প্রকাশিত এক মতামতধর্মী সংবাদে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালদ্বীপে চীনের প্রভাব অনেক বেড়েছে। চীন সেখানে অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগও পেয়েছে। মূলত চীনের সমর্থনেই এখনো টিকে আছে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সরকার। তাই ভারত সরকারের উচিত, সামরিক হুমকির সঙ্গে সঙ্গে মালদ্বীপের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। একই সঙ্গে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখতে হবে।
অন্যদিকে জরুরি অবস্থা জারির পরপরই টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, সেনাদের প্রস্তুত রেখেছে ভারত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শর্তের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়েছিল, যেকোনো মুহূর্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
১৯৮৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের আহ্বানে মালদ্বীপে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল ভারত। ওই ঘটনার উল্লেখ করে ফার্স্টপোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, যদি আবদুল্লাহ ইয়ামিন জাতিসংঘের শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতার প্রস্তাবে রাজি না হন, তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত। চীনের কারণে ভারতের সম্ভাবনাময় ‘পরাশক্তি’সুলভ ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। মালদ্বীপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপ করতেও দ্বিধা করা যাবে না।
হিন্দুস্তান টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের মাখামাখিই ভারতের মাথাব্যথার কারণ। মালদ্বীপকে ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলেছে চীন। আর চীনের সমর্থন পেয়েই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন আবদুল্লাহ ইয়ামিন। সরিয়ে রেখেছেন একসময়ের ‘ভারতই প্রথম’ নীতিকে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের কাছে ১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ বাড়ির পেছনের উঠোনের মতো। ভারত কোনো পরিস্থিতিতেই সেখানে চীনের আধিপত্য দেখতে চায় না। এ কারণেই মালদ্বীপের সংকট হয়ে উঠেছে ভারত ও চীনের দ্বৈরথের কারণ।
ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো আলেক্সেই কুপরিয়ানভ মনে করেন, যদি হুট করে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন চীনা সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে অনুমোদন দেন বা নিজেকে একনায়ক হিসেবে ঘোষণা দেন—তবে ভারত অবশ্যই সেনা পাঠাবে। যদি বর্তমান অবস্থাই চলতে থাকে, তবে ভারতের পরাশক্তিসুলভ ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন পিছু হটলে জয়ী হবে ভারত।
অর্থাৎ ভারত ও চীনের দ্বৈরথে কে জয়ী হবে—এ প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে মালদ্বীপের সংকটের সমাধান। সময়েই বোঝা যাবে জল কোন দিকে গড়াবে। তা এক দিনে হতে পারে, আবার মাসের পর মাসও চলে যেতে পারে।