জেনারেল রাওয়াত এই কথিত অভিবাসনকে ‘লেবেন্সরম’করণ বলে উল্লেখ করেছেন।
লেবেন্সরম একটি জার্মান শব্দ। এর মানে হলো ‘বসবাসের জায়গা।’ মূলত, নাৎসি জার্মানির আদর্শে এই শব্দটি উল্লেখিত ছিল। এর মানে হলো দেশের সীমানা সম্প্রসারণ করা। জেনারেল রাওয়াতের মতে, এই কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ হলো সীমানা সম্প্রসারণের অংশ। শুধু তা-ই নয়। রাওয়াত এজন্য পাকিস্তান ও চীনকে দায়ী করেছেন।
‘লেবেন্সরম’, চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও এআইইউডিএফ। এসব নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু ‘কী’ বলা হয়েছিল, তার চেয়ে এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কে’ এসব কথা বলেছেন। দেশের একটি রাজনৈতিক দল নিয়ে বিরূপ পর্যবেক্ষন করা বা ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের মন্তব্য করাটা বেশ অস্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং, ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণের বড় এক প্রক্রিয়ার অংশ এটি। সেনাবাহিনী এখন ক্রমেই প্রকাশ্যে বিতর্কে সামিল হচ্ছে। যেকোনো গণতন্ত্রের জন্যই এটি উদ্বেগজনক। কারণ, গণতন্ত্রে রাজনীতি শুধুমাত্র বেসামরিক মানুষেরই করার কথা।
এর আগে গত সপ্তাহে হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদুদ্দিন ওয়াইসিকে নিয়ে সেনাবাহিনী তির্যক মন্তব্য করেছে। ভারতের মুসলমানরা দেশপ্রেমিক নয়, এমন অভিযোগের জবাবে ওয়াইসি বলেছিলেন, কাশ্মীরের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় যে সাতজন মারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মুসলিম সেনা ছিলেন ৫ জন। অন্য রাজনীতিকরা ওয়াইসির মন্তব্যের জবাবে কিছু বলার আগেই, খোদ সেনাপ্রধান বলে বসলেন যে, ওয়াইসি ‘শহীদদের সাম্প্রদায়িকীকরণ’ করছেন।
সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে রাওয়াতের লাগামছাড়া মন্তব্য প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে রাজনীতির গ-িতে প্রবেশ করেছে। জানুয়ারিতে দোকলাম সংকট নিয়ে চীনকে আক্রমণ করেন রাওয়াত। এ সময় তিনি বলেন, চীনকে মোকাবিলায় বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতিক, সামরিক ও আংশিদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাওয়াতের ওই বক্তব্যের জবাব দিয়েছে। আরও উদ্বেগের কারণ হলো, রাওয়াত দেশের পারমাণবিক নীতিমালা নিয়েও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক ‘ধাপ্পাবাজি’কে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত ভারত। কাশ্মীর নিয়েও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছেন সেনাপ্রধান। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কাশ্মীরের যেসব বেসামরিক নাগরিক হস্তক্ষেপ করবেন, তাদেরকে ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তাদেরকে মোকাবিলায় সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগও করতে পারে।
পরিস্থিতি এই অবস্থায় কীভাবে এল? এর একটি বড় কারণ হলো ২০১৪ সালে বিজেপির উত্থান ও দলটির পৌরুষ প্রদর্শনের চর্চা। এই পুরুষত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামরিকবাদ। জাতীয় নিরাপত্তা, পাকিস্তান নিয়ে সামরিক পদক্ষেপ ও সন্ত্রাসবাদ ছিল নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারাভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সাবেক এক সেনাপ্রধানকে মন্ত্রীসভায়ও বসিয়েছে।
২০১৬ সালে দু’জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে বিপিন রাওয়াতকে সেনাপ্রধান করা হয়। ১৯৪৭ সালের পর এমন নজির এর আগে একবারই ছিল। পদন্নোতি পাওয়ার পর সেনাপ্রধান রাওয়াত প্রায়ই মোদি সরকারের বিভিন্ন অবস্থানের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। ২০১৬ সালে মোদি ‘ডিমানিটাইজে’র উদ্যোগ নিয়ে ব্যপক সমালোচনা কুড়ান। কিন্তু সেনাপ্রধান এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।
এমনকি এআইইউডিএফ নিয়ে তার বুধবারের বক্তব্যের সময়ও তিনি বলেন, মোদি সরকার এখন উত্তর পূর্বাঞ্চলকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যবেক্ষন করছে। ২০১৬ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সীমান্তের নিয়ন্ত্রনরেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানী চৌকিতে আক্রমণ করে, তখন একে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ আখ্যা দিয়ে বিজেপি ব্যপক রাজনৈতিক প্রচার চালায়। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে বিজেপি এই অভিযানকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করেছে।
অপরদিকে সেনাবাহিনী ওই অভিযানে অংশ নেওয়া দলকে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি কাশ্মীরে মানববর্ম ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর লিতুল গগৈকে সংবাদ সম্মেলনে নিজের পক্ষালম্বন করে বক্তব্য দেয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়।
এ সব কিছুতে বিজেপি একটি বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু একমাত্র নয়। ভারতের অনেক কিছুতে সামরিকবাদ অনুপ্রবেশ করেছে। নানা বিষয় নিয়ে টিভি চ্যনেলে সম্প্রচারিত বিতর্কে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা এখন নিয়মিত হাজির হন। পরিহাসের বিষয় হলো, যারা প্রায়ই এই সামরিকবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাদেরকেও সেনা চৌহদ্দির মধ্যেই নিজের যুক্তি গঠন করতে হয়। যেমন, বিজেপির এক মুখপাত্র একবার এক টিভি বিতর্কে বলেন, প্রগতিশীল ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারের দেশপ্রেম নেই। এই বক্তব্যের বিপরীত যুক্তি হিসেবে কানহাইয়া কুমার বলেন, তার পরিবারের ১৬ জন সদস্য নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করেছেন। এদের একজন কর্মরত অবস্থায় নিহত হন। অর্থাৎ, কানহাইয়া কুমারকে নিজের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হচ্ছে এভাবে।
এটি বেশ উদ্বেগজনক ব্যাপার। গণতন্ত্রের জন্য সামরিকবাদ খুবই মারাত্মক। কারণ, রাজনীতি হতে হবে বিভিন্ন ধ্যানধারণার প্রতিদ্বন্দ্বীতার ভিত্তিতে। বন্দুকওয়ালা জওয়ানরা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বটে। কিন্তু তাদের রাজনীতিতে পদার্পন অভনিপ্রেত। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সেনাবাহিনী প্রায়ই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। অভিজাত গোষ্ঠীর সমর্থনের কারণেই এসব সাধারণত হয়। এই অভিজাতরা মনে করেন, সেনা শাসন গণতন্ত্রের চেয়ে কম ঝঞ্ঝাটময়। যেমন, পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রায় অর্ধেক সময় সেনাশাসন বিরাজমান ছিল। পাকিস্তানেও আজ এই বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া হয় যে, সেনা শাসন ও সামরিকবাদ দেশটিকে পিছিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে গণতন্ত্র ভারতকে এগিয়ে নিয়েছে। ভারত ও দেশটির সেনাবাহিনীর উচিত এই সামরিকবাদের ফাঁদ এড়ানোর ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকা।
(শোয়েব দানিয়ালের এই নিবন্ধটি ভারতের অনলাইন সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ইন থেকে নেওয়া হয়েছে।)