ক্রমাগত লোকসানের ভারে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন চিনি উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। কেন এই লোকসান? এ লোকসানের মূল কারণ প্রতিষ্ঠানটি যে চিনি উৎপাদন করে তার ব্যয় অনেক বেশি। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে বিএসএফআইসির প্রয়োজন পরে ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এই চিনি বিক্রি করা হয় ৬৫ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি চিনিতে লোকসান গুনতে হয় ৩৫ টাকা। বেশি দাম হওয়ায় এই চিনি তেমন বিক্রিও হয় না। কারণ বাইরে থেকে আমদানি করা চিনির বাজারে গড় বিক্রি মূল্য ৫৫ টাকা কেজি। সে হিসাবে বাজার মূল্যের থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৪৫ টাকা বেশি। বিক্রি না হওয়ায় এখন বিএসএফআইসির গুদামে অবিক্রীত চিনি পড়ে আছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন।
এই তো গেল উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় লোকসানের চিত্র। এরপর ‘মান্ধাতার’ আমলের যন্ত্রপাতি এবং এর পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতিও প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের লোকসানের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই লোকসান পূরণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রতি বছর অর্থও দেয়া হয়। যেমন বিগত চার অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৪০৫ কোটি টাকা। এখন আবার নতুন করে সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছে বিএসএফআইসি। অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে চিনি ও খাদ্য শিল্প উৎপাদন করপোরেশন চিনিকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি, বেতনভাতা ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যয়নির্বাহের জন্য নতুন করে ৩৫০ কোটি টাকা চেয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিএসএফআইসি ২০০৬-০৭ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি করায় (উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দরে) লোকসান দিতে হয়েছে এক হাজার ৪০৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ওপরের সিদ্ধান্ত ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনক্রমে ২০১০-১২ সালে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করে তা কম মূল্যে বাজারে বিক্রি করায় বিএসএফআইসির ট্রেড গ্যাপ হয়েছে ৪৮৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
লোকসান ও ট্রেড গ্যাপের কারণে আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃক চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আখ মাড়াই মওসুমে শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি ও বেতনভাতা ও চিনি উৎপাদন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যয়নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চিনিকলগুলো সচল রাখতে ভর্তুকি ও ট্রেড গ্যাপ সমন্বয় শর্তে ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে করপোরেশনটি দাবি করেছে এবং এ পরিমাণ টাকা অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৫ লাখ টন। এ চাহিদার বিপরীতে বিএসএফআইসির উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার টন। চাহিদার মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানটি জোগান দিয়ে থাকে। বাজারে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহ করা চিনির দামের চেয়ে বিএসএফআইসির চিনির দাম বেশি হওয়ায় গুদামে এ বছর ৬০ হাজার টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় মজুদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, বিগত চার অর্থবছরের ভর্তুকি ও ট্রেড গ্যাপ সমন্বয়ের জন্য বিএসএফআইসিকে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৭৫ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৩৫ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে ৩৫০ কোটি টাকা চাওয়ায় অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। গত সপ্তাহে পাঠানো সেই সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প উৎপাদন করপোরেশন বর্তমান ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বিদ্যমান বাজার দরে চিনি উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বছর বিপুল অর্থ লোকসান হচ্ছে। এ ছাড়া চিনি আমদানি করা বিএসএফআইসির মূল কাজ (কর বিজনেস) না হওয়া সত্ত্বেও চিনি আমদানি করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেও প্রচুর অর্থ লোকসান দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ পরিস্থিতিতে চিনির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসএফআইসিকে সচল রাখার স্বার্থে চিনিকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি ও বেতনভাতাসহ চিনি উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যয়নির্বাহের জন্য আবার ৫০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অর্থমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ কোটি টাকা দেয়া হবে এবং চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএসএফআইসির অনুকূলে ভর্তুকি খাতে তা সমন্বয় করা হবে।