এরশাদ যেভাবে রাজনীতিতে টিকে গেলেন!

Slider রাজনীতি

195336Ershad_pic

বাংলাদেশে ৩৫ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা কালক্রমে গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল এবং নব্বইয়ের শেষে জেনারেল এরশাদের শাসনের পতন হয়েছিল। গণআন্দোলনের মুখে পতন হলেও যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন জেনারেল এরশাদ তার চিত্র ফুটে উঠেছে বিবিসির বিশ্লেষণে।

ঢাকায় শিক্ষাভবনের উল্টো পাশে কার্জন হলের সামনের রাস্তায় জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেই ৮৩সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রথম ছাত্র মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।

সেখানে নিহত ছাত্রদের স্মরণে রাস্তার কোণায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেই মিছিলের একজন সংগঠক, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলছেন, গত সাড়ে তিন দশকে দেশের রাজনীতিতে জেনারেল এরশাদের একটা অবস্থান দেখে তাদের এখন দু:খ হয়।

সেই যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, পরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রমিক, আইনজীবীসহ পেশাজীবীদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে সাতদল এবং এর বাইরে অন্যান্য দল যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছিল। আন্দোলন মাঝেমধ্যে থমকে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত সব দলের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। তখন তাঁকে জেলে নেয়া হলেও পরে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার মতো তাঁর একটা অবস্থান তৈরি হয়।

অধ্যাপক রওনক জাহান মনে করেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, প্রধান দুই দলের কাছে ভোটের রাজনীতি প্রাধান্য পায়। সেই সুযোগে জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে বৈধতা পেয়েছে।

তিনি বলেছেন, জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরে এলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, প্রধান দুই দলের কাছে ভোটের রাজনীতি প্রাধান্য পায়। সেই সুযোগে জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে বৈধতা পায় বলে তিনি মনে করেন।

“যেহেতু প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের শেয়ার খুব কাছাকাছি, এবং আমাদের যে ইলেকটোরাল সিস্টেম, তাতে কোন নির্বাচনী এলাকায় কেউ অল্প ভোটের ব্যবধানে জিতে যেতে পারেন। ফলে এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং অন্যদিকে জামায়াত, যাদের কাছে ছয় বা সাত শতাংশ ভোট আছে, প্রধান দুই দল তাদের কাছে টানে। এভাবেই এরশাদ রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়ে যাচ্ছেন।”

লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, আমাদের দেশে রাজনীতির যে বিভাজন, দুই পরাশক্তি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ, এদের একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে খেলিয়ে অনেক সময় এরশাদ এর সুবিধা নিতে পেরেছেন। তিনি বলছেন, প্রধান দুই দলের বিভেদের রাজনীতির সুযোগ নিয়ে এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। ক্ষমতা ছাড়ার পরও একই ধরণের সুযোগ তাঁর কাছে এসেছে বলে তিনি মনে করেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলছিলেন, আমরা তো সুদূর অতীতটা ভুলে যাই, নিকট অতীত মনে রাখি। এরশাদের যত খারাপ কাজ আছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, সংবিধানকে বিকৃত করা, এগুলো অনেক কিছু করেছে। কিন্তু ঐ যে গণতন্ত্রের কথা বলেন যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি তারা তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তাকে শাস্তি দিতে চায়নি। এবং শাস্তি যদি দিতেও চেয়ে থাকে,সেটাও হচ্ছে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে ব্যবহার করার জন্যে। এজন্যেই কিন্তু এরশাদ টিকে গেছে।

সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ জেনারেল এরশাদকে এক ধরণের বৈধতা দিয়েছিল বলে দলটির বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে।

পরে ১৯৯৬ সালে সরকারের গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা মহাজোট করেছিল। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও অনেক নাটকীয়তার পর শেষপর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে সাথে রাখতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে রয়েছেন জেনারেল এরশাদ। তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ সাংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। একইসাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের জাতীয় পার্টি থেকে তিনজন মন্ত্রী আছেন।

ফলে আওয়ামী লীগের ওপরই দায় বেশি আসে। কিন্তু দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম মনে করেন, এরশাদের অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রে ভোটারদেরও ভূমিকা আছে। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন ওনার পতন হয়, তারপরই কিন্তু নির্বাচনে উনি নিজে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন। ঐটিই ছিল তাঁর ভিত মানে রাজনীতির পুনর্বাসন।

শেখ সেলিম আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগ তাকে টেনেছে কী করে, বরং বিএনপিই টানার চেষ্টা করেছে। বিএনপি যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, যেমন ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলাসহ অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাদের কাউন্টার পার্ট যখন আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তখন কেউ যদি আমাদের সাথে আসতে চায়, আমরা ডিনাই করতে পারি না। সেজন্যই আমরা এরশাদের সাথে মহাজোট করি।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল খান বলেছেন, এটা দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের অন্যদেশের মতো এখানেও দুই দল দেখতে চায়। কিন্তু আমরা এই দুই দলই অনেককে সাথে নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ঐ সরকারের সময়ে আমাদের সবার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়েছিল। আমাদের উপর আওয়ামী লীগের এ ধরণের নিপীড়নের কারণেই এরশাদ এবং জামায়াতকে নিয়ে আমরা চারদলীয় জোট করেছিলাম।

ভোটের রাজনীতি যখন প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন প্রধান দুই দলের জোট গঠনের ক্ষেত্রে আদর্শের মিল বা নৈতিকতা কতটা কাজ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলই স্ব স্ব আদর্শ বহাল রেখে অন্য দলের সাথে ঐক্য করার দাবি করছে।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, তাদের দলের অবস্থান মেনে নিয়েই জাতীয় পার্টি জোটে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের আদর্শ বা নৈতিকতা থেকে একপাও সরে আসি নি। আমাদের যে আদর্শ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এগুলো মেনে আমাদের সাথে কেউ এলে, সেখানে তো আপত্তির কোন কারণ নেই।

দুই দলের কাছে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের যে কদর রয়েছে, সেটা যে রাজনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, দল দু’টোর নেতারা অবশ্য তা স্বীকার করেন।

বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত কেউ যাতে রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে না পারে, সে ব্যাপারে দলগুলো থেকেই একটা চেষ্টা হওয়া প্রয়োজন। তবে এই চেষ্টাটা করবে কে, সেই প্রশ্নের জবাব কিন্তু মেলেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *