ভালোবাসাকে কি তালা-চাবি দিয়ে বন্দী করা যায়?
দিব্যি যায়। কিন্তু কী করে? সে জন্য প্রেয়সীর হাতে হাত রাখতে হবে আগে। তারপর সুন্দর একখানি তালায় দুজনের নাম লিখে সেতুতে দাঁড়িয়ে দুজনে মিলে তালা ঝুলিয়ে দিন। তারপর দুই যুগল চক্ষু বুজে চাবিটা ছুড়ে ফেলে দিতে হবে নদীর জলে। কথিত আছে, এতে ভালোবাসা অমরতা পায়। সেতুর নিচের প্রবহমান নদীতে ঝাঁপ দিয়ে চাবি খুঁজে নিয়ে সে তালা খোলে—এমন সাধ্য কী আর কারও আছে বলুন?
বিষয়টি শুনে যারা অবাক হচ্ছেন, তারা বরং একবার এসে ইউরোপ ঘুরে যান। অপর প্রেমের এ গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে ইউরোপের প্রায় সব দেশেই। তালাবন্দী এ অমর ভালোবাসার নিশান চোখে পড়ে প্রথম প্যারিসে ‘পন্ট দে আর্টস’ সেতুতে। এটি প্যারিসের প্রথম ধাতব সেতু। নামকরণ করা হয়েছিল প্রথম ফরাসি সম্রাটের নামানুসারে। এর একপাশে ইনস্টিটিউট অব ফ্রান্স আর অন্য পাশে লুভর প্যালেসের কেন্দ্রীয় স্থাপনা। এ সেতুর আরেক নাম ভালোবাসার তালাবন্দী সেতু। ভালোবাসাকে তালা-চাবি দিয়ে বন্দী করা যায় কিনা, তা কেবল এখানকার প্রেমিকারাই বলতে পারবেন। তালায় দুজনের নাম লিখে এ সেতুতে দুজনে মিলে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তারা চাবিটা ছুড়ে ফেলে দেন সিন নদীর জলে। কথিত আছে, এতে ভালোবাসা অমরতা পায়। সেতুর নিচের প্রবহমান সিন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে চাবি খুঁজে নিয়ে সে তালা খোলে-এমন সাধ্য কী আর কারও? হতে পারে এটা ছেলেমানুষী। ভালোবেসে ছেলেমানুষি হলে ক্ষতি কী তাতে! বিষয়টা কিছুটা বুকের ঢিপঢিপানি নিয়ে ছোটবেলায় দেয়ালে যোগ চিহ্ন দিয়ে নামের আদ্যক্ষর লিখে রাখার মতো। এভাবেই হয়তো দেশে দেশে কালে অবিনশ্বরতা পায় ভালোবাসা। পন্ট দে আর্টস সেতু নিয়ে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত ফরাসি সিনেমা ‘লে পন্ট দে আর্টস’। ফরাসি তরুণ-তরুণীর করুণ প্রেমকাহিনি নিয়ে এই সিনেমা। প্রেমিকের সঙ্গে অভিমান করে অভিমানী প্রেমিকা এই সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে সিন নদীতে আত্মহত্যা করে। সইতে না পেরে প্রেমিকও একই সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয় প্রেমিকার সঙ্গে মিলনের আশায়। সিন নদীর ওপর এ রকম প্রায় ১১টি ভালোবাসার তালাবন্দী সেতু রয়েছে পুরো প্যারিসে।
কেবল প্যারিসের এই সেতু নয়, অস্ট্রিয়ার ইনসব্রুখ শহরে গিয়েছিলাম তুষারকন্যা আল্পস পর্বতমালা দেখতে। নিচে ইন নদীর শীতল ধারা আর ওপরে সুদৃশ্য সেতু। সেখানকার সেতুগুলোরও শোভা বাড়িয়েছে লাল-নীল-সবুজ-কমলা বাহারী তালারা। এখানকার গল্পটা একটু আলাদা। এখানে আছে পর্বতের কাছে হার না মানার ভালোবাসার গল্পেরা। তুষারকন্যাকে সাক্ষী রেখে প্রেমিক যুগল বাঁধে ভালোবাসার তালা। তারপর চাবিটা ছুড়ে দেয় খরস্রোতা ইন নদীতে। স্রোতে ভেসে সে চাবি কোথায় হারায় কে জানে! আর হিম শীতল জলে ঝাঁপ দিয়ে চাবির খোঁজে মারা যাওয়ার সাধ যে কারওরই হবে না তা সহজেই অনুমেয়।
ভূমধ্যসাগর পাড়ের ভালোবাসার তালার চাবি খুঁজতে সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন ভাবলে বড় ভুল হবে। কারণ স্পেনের ভালোবাসার গল্প সাগরে নয়; পাহাড়ের সঙ্গে মিতালি পেতেছে। পার্ক গুইলের পাহাড় চূড়ায় আকাশের সঙ্গে হাতছানি দেয় এখানে ভালোবাসা। সাগরের মৃদু গর্জন মনে মেখে তালায় দুজনের নাম লিখে পাহাড়ের ঢালের ধাতব বেড়ায় দুজনে মিলে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে চাবিটা ছুড়ে ফেলে দেয় অসীম অতলে। সূর্য তখন দূর দিগন্ত রেখায় টুপ করে ডুব দেয় লাজুক প্রেয়সীর মতো। ভালোবাসার তালাদের মাঝেও শুরু হয় কানাকানি। কোনো কোনো তালা আবার পার করে যুগল প্রেমের বর্ষপূর্তি।
প্রাগে বেড়াতে গেলাম যেবার, সেখানেও চার্লস সেতুর ওপরে রূপসী রঙিন তালাদের দেখা পাই। নকশি করা ধাতব বেড়ায় তালা ঝুলছে একেকটি রঙিন নক্ষত্রের মতো। প্রাগ ঘোরাঘুরির পর আমরা গিয়েছিলাম চেক প্রজাতন্ত্রের ছোট্ট শহর লিটোমসলে। সেখানে গিয়ে দেখলাম যুগল নাম বন্দী করা হৃদয় আকৃতির ছোট ছোট কাগজে। প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের নাম কাগজে লিখে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় ভালোবাসা কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে। লোক মুখে শোনা যায়, বহু বছর আগে রাজমহলের এখানে রাজকন্যা তার ভালোবাসার মানুষের নাম লিখেছিল। তারপর তারা পরম সুখে সেখানে বসবাস করেছিল! আমিও এক ফাঁকে আমার ভালোবাসার নামটি লিখে পরম যতনে দেয়ালে ঝুলিয়ে এসেছিলাম!
জার্মানির রাইন নদীর ভালোবাসার তালাগুলোকে বেশ চুপচাপ মনে হয়েছে আমার। গত বছরের মাঝামাঝি ঘুরতে গিয়ে দেখা পাই তাদের। ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে মধ্যবয়সী দুজন স্বামী-স্ত্রী লাগাচ্ছিলেন তালা। তাদের দুজনের অনামিকার আংটির দিকে তাকিয়ে মনেই হয়নি বিয়ের পর ভালোবাসা কমে যায়! আসলে সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো দিনই কমে না। তির তির বাতাসের বুক চিরে বয়ে চলা রাইনের শাখা বড়ই লাজুক আর ভীরু। ফিসফিসিয়ে গায় অমর প্রেমগাথা। নদীর বুকে সন্ধ্যা নামে। ঘুমিয়ে পড়ে জার্মান নগরী। জেগে থাকে কেবল তালাবন্দী ভালোবাসারা।
ভালোবাসাকে সত্যি সত্যি তালা-চাবি দিয়ে বন্দী করা যায় কিনা, সে তর্কে বরং না যাই। ভালোবাসা তো আর যুক্তি-তর্ক মানে না। আর পৃথিবীর সকল ভালোবাসার শহরে ভালোবাসার তালাও রোজই ঝুলছে। কার সাধ্য বাধা দেয়! ভালোবাসা দিবসে আমরা চাই পৃথিবীর সকল কোণের ভালোবাসাগুলো অমর হোক। এ ভালোবাসা দিবসের দিন দুম করে প্রেমে পড়তে যাওয়া তরুণ-তরুণীটিকে বলতে চাই, দুজনের মনের তালা বাঁধার আগে খানিকটা ভেবে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। বিচ্ছেদের নদী বড়ই শীতল। কখনো কখনো সে কেড়ে নেয় জীবন। আমরা ভালোবাসায় বিচ্ছেদ চাই না। আমরা চাই ভালোবাসা আজীবন।
শান্তা তাওহিদা: জার্মানি।