খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার পরিচারিকা মোছা ফাতেমাকে তাঁর সঙ্গে রাখার আবেদন করা হয়েছে।
সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ের পর খালেদা জিয়াকে ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে আসামিদের বাচ্চাদের জন্য একসময় ব্যবহৃত কিডস ডে কেয়ার সেন্টারের তিনতলা ভবনের নিচতলায় দুটি রুমে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে রায় ঘোষণা করা হয়। এর আধা ঘণ্টা পর খালেদা জিয়াকে কড়া পুলিশি পাহারায় কারাগারে নেওয়া হয়।
একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ মামলার অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি চার আসামি হলেন সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান। এর মধ্যে পলাতক আছেন তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।
পাশাপাশি ছয় আসামির প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
এক নজরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা
দুদকের মামলা: ২০০৮ সালের ৩ জুলাই
অভিযোগপত্র: ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট
অভিযোগ গঠন: ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ
আসামির সংখ্যা: ছয়জন
সাক্ষ্যগ্রহণ: ৩২ জন সাক্ষীর
যুক্তিতর্ক শেষ: ২৫ জানুয়ারি
বিচারের সময়: ২৩৬ কার্যদিবস
যুক্তিতর্ক শুনানি: ১৬ কার্যদিবস
বিদেশ থেকে পাঠানো এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এই মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট ছয়জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেন দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশীদ। অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমান। মামলায় শুরু থেকে পলাতক আছেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আদালত খালেদাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩২ জনের সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালত।
খালেদা-তারেকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। সরকারি এতিম তহবিলের আর্থিক দায়িত্ববান বা জিম্মাদার হয়ে বা তহবিল পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে পরস্পর যোগসাজশে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অপরাধ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২.৫৫ লাখ মার্কিন ডলার আসে যা বাংলাদেশি টাকায় তৎকালীন ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯১ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অর্থ দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় না দিয়ে অস্তিত্ববিহীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। অথচ কোনো নীতিমালা তিনি তৈরি করেননি, করেননি কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থাও। অথচ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা অস্তিত্ববিহীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে পাঠান। পরে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন যার জন্য তিনি দায়ী। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বলেন, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থেকে নিজের পদমর্যাদা বলে সরকারি এতিম তহবিলের আর্থিক দায়িত্ববান বা জিম্মাদার হয়ে বা তহবিল পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ করেছেন।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি তাঁর মায়ের সহায়তায় ৬ মইনুল হোসেন রোডের ঠিকানা ব্যবহার করে অস্তিত্ববিহীন ট্রাস্ট গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণ করে ওই ট্রাস্টের নামে সোনালী ব্যাংকের গুলশান নিউনর্থ সার্কেল শাখায় এসটিডি হিসাব খুলে জমা রাখেন। দীর্ঘ দিনে কিছু জমি কেনা ছাড়া ট্রাস্টের নামে কোনো স্থাপনা করেননি। ডিড অব ট্রাস্টের শর্ত ভঙ্গ করে এতিম ও দুস্থদের জন্য কোনো টাকা তিনি ব্যয় করেননি। অথচ ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত অসৎ উদ্দেশ্যে ৫টি চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ট্রাস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যবসায়ী কাজী সলিমুল হককে দেন। যার মধ্যে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন যা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অপরাধ।
সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবের দায়িত্বে ভারপ্রাপ্ত হয়ে এতিম তহবিল গঠন ও পরিচালনার দায়িত্ববান হন। অথচ কোনো নীতিমালা তৈরি না করে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদন নেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের দিয়ে গঠিত অস্তিত্ববিহীন ট্রাস্টে টাকা পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকৃত মূল নথি নিজের দায়িত্বে রেখে বা নিচের স্তরের কাউকে না দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি উধাও করে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সরকারি টাকা আত্মসাতের কাজে সহায়তা করেছেন।
অভিযোগপত্রে জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান সম্পর্কে বলা হয়, তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন।