ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও যথাযথ জামানত না নিয়ে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। একপর্যায়ে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর আটকে যাচ্ছে ব্যাংকের খাতায়। এসব ঋণ আদায়ে মামলা করার নির্দেশনা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। মামলা না করেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা অবলোপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টম্বরের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাত এমনি প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানী টিম তিনটি ব্যাংকের ১৫ বছরের অবলোপনকৃত ঋণের তালিকা পর্যালোচনা করে এক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এরই ভিত্তিতে মামলা ছাড়া খেলাপি ঋণ অবলোপন না করাসহ দশ দফা সুপারিশ করে মন্ত্রিপরিষদের সচিবের কাছে চিঠি লিখেছে। একই সাথে এর একটি অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। দুদক এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে।
জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা মন্দ বা ক্ষতিজনক পর্যায়ের খেলাপি ঋণ একপর্যায়ে ব্যাংকের স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। ঋণ অবলোপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালে একটি নীতিমালা তৈরি করে। নীতিমালার আওতায় পাঁচ বছর ও তার বেশি সময় ধরে থাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে ওই ঋণ অবলোপন করা হয়। অবলোপন করা ঋণের হিসাব ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে সরিয়ে আলাদাভাবে হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। এসব ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের আলাদা ইউনিট থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঋণ আদায় খুব কম বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঋণ অবলোপন আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত একটি পদ্ধতি। কৃত্রিমভাবে আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন রোধ করতে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। ব্যাংকগুলো অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখে। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। অবলোপন করা ঋণ ব্যবস্থাপনায় আলাদাভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এ ধরনের ঋণ আদায় হয় খুবই কম। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের মধ্যে পাঁচ সরকারি ব্যাংকসহ শীর্ষ দশ ব্যাংকের ঘাড়েই রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। আবার ৩৬ হাজার কোটি টাকার অবলোপন করা খেলাপিঋণের বিপরীতে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ২৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ দশ ব্যাংকের ১২২ কোটি টাকা রয়েছে। অর্থাৎ অবলোপনকৃত ঋণ তিন মাসে আদায় হয়েছে মোট অবলোপনকৃত ঋণের এক-শতাংশের কম অর্থাৎ মাত্র শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদকের একটি অনুসন্ধানী টিম। এ জন্য তারা সরকারি খাতের একটি ও বেসরকারি খাতের দু’টি ব্যাংক বেছে নেয়। ব্যাংক তিনটি হলো এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। ব্যাংক তিনটির বিগত ১৫ বছরের অবলোপনকৃত ঋণের তালিকা পর্যালোচনা করে প্রত্যেক ব্যাংকের পাঁচটি অবলোপনকৃত ঋণের অবলোপন প্রক্রিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
এরই ভিত্তিতে অনুসন্ধানী টিম ১০ দফা সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী অবলোপনকৃত ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সব পরিচালককে খেলাপি হিসেবে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) চিহ্নিত করার বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। পাশাপাশি মামলা ছাড়া খেলাপি ঋণ অবলোপন না করার নির্দেশনা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। একই সাথে ঋণ অবলোপনের আগেই তার কারণ সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ীরা যে উদ্দেশ্যে ঋণ নিচ্ছে তা ওই কাজে ব্যবহার না করে অনেক ক্ষেত্রে অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানী টিম ব্যবসায়ীদের ঋণের অর্থ অন্যত্র হস্তান্তর করছেন কি-না তা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করা হয়। একই সাথে ঋণ সুপারিশ থেকে অবলোপন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কোনো ত্রুটি বা অনিয়ম আছে কি-না তা উল্লেখ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোর আওতায় ঋণ আদায়ের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ঋণ অবলোপনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বিধান প্রবর্তন করার সুপারিশ করা হয়।
এ দিকে ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আগের বছর পর্যন্ত লভ্যাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখার নিয়ম থাকলেও কোনো কোনো ব্যাংক চলতি বছরের লভ্যাংশ থেকে প্রভিশন করে থাকে। এ অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধান টিমের সুপারিশ পর্যালোচনাক্রমে এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে দুদকের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।