এম আরমান খান জয়,গোপালগঞ্জ :
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বড় কষ্ট ও বেদনা নিয়ে আপনার উদ্দেশে এই নিরুপায় কলম তুলে নিয়েছি। শুরুতেই না বললে নয় বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের বিস্ময়। আর এই বিস্ময় বাংলাদেশের ম্যাজিকের রূপকার আপনি বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাবিরোধী ভয়ংকর কালো আইন ৩২ ধারা ”পরিবর্তন করে আরেকটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবেন বলে আশা রাখি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অসম সাহসী নেত্রী। আপনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা। পৃথিবীর সর্বহারা দুঃখী মানুষের একজন। সীমাহীন কষ্টের বিশাল পাহাড় বুকে নিয়ে কী ভীষণ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আপনার পথচলা..লড়াই আর সংগ্রাম। পিতা, মাতা, ভাই, ভ্রাতৃবধূ আর স্বজন হারানো এই বধ্যভূমির বেদনাশুর মোছাতে, সত্যিকার গণতন্ত্রের ফুল ফোটাতে, তৃণমূলই মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘর। গণতন্ত্রচর্চার উর্বর জমিন। সেখানে এসিড ঢেলে নয়, খাঁটি জল ছড়িয়েই গণতন্ত্রের সবুজ গোলাপ ফোটাতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে অনিরাপদ ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতা। একটু বলতে চাই সংবাদপত্রের দায়িত্ব এবং গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সভ্যতার অন্যতম খুঁটি সংবাদপত্রের অভাবে সভ্যতার রথচক্র থেমে যেতে পারে। রাজনৈতিক দ্বন্দ সংঘাত, সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্পসহ নানা খবর মানুষের দরবারে পৌঁছে দেয় সংবাদপত্র। যার চলার পথে কোন বিরাম নেই, অহোরাত্র জাগ্রত থেকে সুখ-দুঃখের পাঁচালির খোঁজে ছুটে অবিরত। আদর্শিক মতভেদ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রেম-বিরহ, বিবেক কার্যকলাপে সংবাদপত্রই আমাদের শুভ বুদ্ধি জাগরণের মহৎ প্রেরণা। সমাজের উপর যখন অশুভ শক্তির ছায়া পড়ে, অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ যখন ভীম রণভূমে রণিত, যখন দিকে দিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিজয় দম্ভ, রণ হুংকার, রক্তোম্মাদনা, যুদ্ধের করাল বিভীষিকা সভ্যতাকে গ্রাস করে তখন সংবাদপত্রই মানবতা বিরোধী হিং¯্র ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে গড়ে তোলা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ধিক্কার ধ্বনিতে সোচ্চার হয় বিশ্ববাসী, গণবিক্ষোভের পটভূমি হয় জোরালো ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংবাদপত্রই আমাদের সুদূরের আকাংখা পরিতৃপ্তি, আধুনিক জীবনের অতন্ত্র প্রহরী। নির্ভীক আদর্শিক সংবাদপত্র অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সমীহ করে না, করে না কারো সাথে আপস। গণতন্ত্রের সদা জাগ্রত সৈনিক এই সংবাদপত্র সমাজের সকলের কথা বলে। সাধু বেশী সভ্য জগতের পরিচালনাকারীদের স্বরূপ করে দেয় উন্মোচন।
যেকোনো কারণেই বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অর্থ গণতন্ত্রকে খর্ব করা। নতুন আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ধারায় বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের জন্য দীর্ঘ কারাদন্ধের যে ব্যবস্থা সেটা গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাকস্বাধীনতার ওপর এত বিধিনিষেধ থাকার অর্থই হলো আমরা গণতন্ত্র বিসর্জন দিতে চলেছি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে বিকাশ এবং বিস্তৃতি হচ্ছিল সে জায়গায় অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ চলছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভেতরে এমন এমন বিধান, নিয়মকানুন সংযুক্ত করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্ত সাংবাদিকতা বলতে আর কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। বাংলাদেশের মুক্ত সাংবাদিকতা খুব বড়ভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাস্তবায়ন হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে, বিষয়টি এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে একটি দুর্নীতির রিপোর্ট যদি করতে হয় তাহলে দুর্নীতিবাজের কাছে একজন সাংবাদিককে যেতে হবে এবং তাকে গিয়ে বলতে হবে যে আপনি দুর্নীতি করেছেন এবং আপনার দুর্নীতির রিপোর্ট আমাদের দেন। যদি দুর্নীতিবাজ সাংবাদিককে তথ্য-প্রমাণ দেয়, তাও শুধু মৌখিকভাবে দিলে হবে না। লিখিতভাবে দিতে হবে। যদি দেয় তাহলে সাংবাদিক সেই রিপোর্টটা করতে পারবেন। যদি সে লিখিতভাবে অনুমতি না দেয়, শুধু মৌখিকভাবে অনুমতি দেয় তারপর কোনো সাংবাদিক তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসে লেখেন, তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির মামলা হতে পারে। তার জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। এটা ৫৭ ধারার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং নিপীড়নমূলক। অর্থাৎ সাংবাদিকতার নিজস্বতা, অনুসন্ধান, স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকবে না যদি এখন পর্যন্ত যেভাবে আমরা দেখছি, মন্ত্রিসভায় যেভাবে দেখছি এভাবেই যদি আইন পাস করে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আগের ৫৭ ধারা থেকেও নিকৃষ্ট। শুধু সাংবাদিকতা নয় দেশের গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি নিবর্তনমূলক আইন। যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্র এখানেও মানুষের যে তথ্য পাওয়ার ও প্রচার করার অধিকার কিংবা বাক স্বাধীনতা রয়েছে তাকে হরণ করার অপপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারি কর্মচারীদের নানারকম অপকর্ম, দুর্নীতি ঠেকানোর একটি হাতিয়ার হতে পারে ।
বলা হয়েছে,
৫৭ ধারায় মানহানিকর কোনো কিছু প্রচার বা প্রকাশ করলে শাস্তির বিধান ছিল। আর গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে নতুন ডিজিটাল আইন যা করা হচ্ছে তা রীতিমতো ভয়ানক। তথ্য সংগ্রহের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার মতোই আইন করা হয়েছে। এতে সংবাদকর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার বৈধতা নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে হয়। গুপ্তচরবৃত্তি সংবাদকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না আইনে এমন একটি ক্লজ রাখা উচিত। কারণ সংবাদকর্মীরা যেটা করে থাকেন তা হলো জনস্বার্থে। সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অফিসের দুর্নীতিবাজদের তথ্য প্রকাশ করা উচিত জনস্বার্থেই। তা বন্ধ হলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
তাছাড়া এ প্রসঙ্গে আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি। তাই এই আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল করতে হবে। সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা থাকবে না, তা বলব না। কিন্তু এমন আইন করা ঠিক হবে না, যেটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করে।’
‘সাংবাদিকরা গুপ্তচরবৃত্তি করে না। বিভিন্ন উৎস থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা তাদের পেশাগত অধিকার। নতুন আইনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। সামনে নির্বাচন আছে, নতুন আইন সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক, ভয়-ভীতি তৈরি করবে। আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হলে অপব্যবহার হবেই।’
বলা হয়েছে,সরকারি অফিসের ডকুমেন্ট কপি করলে ১৪ বছরের জেল হতে পারে, এটা কোনো সভ্য সমাজের জন্য কাম্য হতে পারে না। যখন দুর্নীতি হয় তখনই কেবল সাংবাদিকরা সরকারি ডকুমেন্ট সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এই আইনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একধরনের ‘রক্ষাকবচ’ দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্যে এম আরমান খান জয়ের।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ৩২ ধারা বড় ধরনের বাধা হবে। অনেক সাংবাদিক এই ধারার শাস্তির ভয়ে বড় কোনো খবরের তথ্য সংগ্রহ অনেক সময় এড়িয়ে যেতে চাইবেন।’
‘ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হলে তা হবে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপন্থী। সাংবাদিকরা যত সহজ ও কম সময়ে তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন সেটি তাঁর জন্য তত সহায়ক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারার অপপ্রয়োগ হলে তা সাংবাদিকদের ওপর খড়গ হিসেবে আবির্ভূত হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে।’ আমরা জানি, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার সাংবাদিকবান্ধব সরকার। তাই এটি পাসের আগে বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস। সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে বলে আমরা আশা করি।’
বিশেষ করে ৩২ ধারায় যা বলা হয়েছে তাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ আইন বলবৎ থাকলে তথ্য যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ থাকবে না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও করা যাবে না।
এছাড়া এ আইনের শাস্তির বিষয়টিও অসমাঞ্জস্য রাখা হয়েছে ।
৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে যে আইন আসছে তাতে আলসার নাম পরিবর্তন করে ক্যান্সার নামকরণ করার মতো হয়েছে। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না,