ভোর ৬টা। বান্ধবীকে নিয়ে পিকনিকে যাওয়ার জন্য পল্লবীর ১১ নম্বর থেকে রিকশায় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের উদ্দেশে রওয়ানা হন মমতা মল্লিক (২৩)। কিন্তু মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের প্রশিকা ভবনের বিপরীতে স্বপ্ন সুপারশপের সামনে পৌঁছামাত্রই পেছন থেকে দ্রুতগতির একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার রিকশার সামনে এসে গতি রোধ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বান্ধবীর ভ্যানিটি ব্যাগটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় প্রাইভেট কারে থাকা ছিনতাইকারীরা। ঘটনাটি গত ২৬ জানুয়ারি শুক্রবারের।
এ ঘটনার ঠিক ঘণ্টাখানেক আগে ধানমন্ডিতে ঘটে আরেক ভয়ঙ্কর ঘটনা। গ্রিন রোডের লাইফ কেয়ার হাসপাতালের আয়া হেলেনা বেগম (৩৫) স্বামী মনিরুল ইসলামের সাথে বরিশাল থেকে লঞ্চে সদরঘাট পৌঁছান। এরপর বাসে ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডে নেমে স্বামীর হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ করে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার থেকে দুর্বৃত্তরা হেলেনার হাতের ব্যাগ ধরে টান দেয়। হেলেনা ব্যাগটি শক্ত করে ধরে রাখায় তাকে টেনে-হিঁচড়ে বেশ কিছু দূর নিয়ে যায়। একপর্যায়ে হেলেনা ওই প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। ছিনতাইকারীরা তার ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
গত ১৮ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় ছিনতাইকারীরা চলন্ত রিকশায় থাকা এক নারীর ব্যাগ ধরে টান দিলে ওই নারীর কোল থেকে পড়ে মারা যায় তার পাঁচ মাসের শিশুসন্তান। আকলিমা নামের ওই নারী ওই দিন ভোরে দুই শিশুসন্তান নিয়ে লঞ্চে সদরঘাটে পৌঁছান। এ সময় তার স্বামী শাহ আলম বড় ছেলেকে চিকিৎসার জন্য শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। আর শিশু আরাফাতকে নিয়ে আকলিমা রিকশায় শনির আখড়ায় বোনের বাসায় যাচ্ছিলেন। পথে দয়াগঞ্জের মোড়ে ব্রিজের কোনায় পৌঁছালে হঠাৎ দুই-তিনজন ছিনতাইকারী আকলিমার ব্যাগ ধরে টান দিলে শিশু আরাফাত নিচে পড়ে যায়। শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এভাবেই নগরীতে ভোরবেলায় প্রাইভেট কারে থাকা দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন পথচারীরা। অনেক সময় এই দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ দিতে হয় অনেক পথচারীকে। ছিনতাইকারীদের হাতে গত ৭ মাসে অন্তত ১০ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। বড় কোনো ঘটনা জানাজানি হলেও নিত্যদিনকার ছোট ঘটনাগুলো থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ঝামেলা এড়াতে ছোটখাটো ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানামুখী হচ্ছেন না। কেউ কেউ আবার থানায় গিয়ে অভিযোগ করলেও প্রতিকার মিলছে না। উদ্ধার হচ্ছে না ছিনতাই হওয়া অর্থ ও জিনিসপত্র।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছিনতাই হলেও পুলিশ সে মামলা নিতে চায় না। বেশির ভাগ েেত্রই হারানো জিডি করার পরামর্শ দেয়া হয়। কিছু কিছু ঘটনায় মামলা হলেও আসামি গ্রেফতার বা মালপত্র উদ্ধারের নজির নেই। চাঞ্চল্যকর ছিনতাই বা হত্যা করে ছিনতাইয়ের ঘটনার পরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নড়েচড়ে বসে কিছু ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে আবারো ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভোরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের তেমন চেকপোস্ট থাকে না।
নগরীতে প্রাইভেট কারে ছিনতাই চক্রের ত্রিশ থেকে চল্লিশটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এসব গ্রুপ গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই করে থাকে। সপ্তাহে তিন চার দিন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা এ ছিনতাই করে। এ ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা ছুটির দিনের ভোরবেলাকেই বেশি বেছে নেয় বলে পিবিআইর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছিনতাই বা টানা পার্টির বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই তারা ছিনতাই করে। এ ছাড়া ছিনতাই মামলায় আসামিদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠালেও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বেরিয়ে ফের ছিনতাইয়ে লিপ্ত হয়।
মিরপুরের ভুক্তভোগী মমতা মল্লিক জানান, গাড়ির ভেতর থেকে দুই দুর্বৃত্ত বেরিয়ে এসে চাপাতি ও ছোরা ঠেকিয়ে তার বান্ধবীর ব্যাগটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। এ সময় ব্যাগের মধ্যে থাকা দু’টি সিম্ফনি মোবাইল, সাড়ে চার হাজার টাকা, কসমেটিকস ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পিবিআইতে একটি অভিযোগ করেন মমতা মল্লিক।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো সূত্র জানায়, ভুক্তভোগীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে পিবিআই। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনের রাস্তা থেকে দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তারা হলো আবদুল আউয়াল হাওলাদার ও বেল্লাল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাইকৃত দু’টি মোবাইল উদ্ধার ও সাদা রঙের চোরাই একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ ১৩-৪৬৫৬) আটক করা হয়।
পিবিআইর ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাইভেট কারে পথচারীদের গতিরোধ করে যে ছিনতাইগুলো হয়, এসব গাড়ির বেশির ভাগই চোরাই গাড়ি। আউয়াল ও বেল্লালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ওই দিন ছিনতাইয়ের সময় তাদের সাথে আরো একজন ছিল, তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নগরীতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি গ্রুপ সক্রিয় আছে, যারা বিভিন্ন সময়ে প্রাইভেট কার নিয়ে ছিনতাই করে। এরা বিশেষ করে ছুটির দিনের সকালবেলাকেই বেশি বেছে নেয়। গ্রেফতার এড়াতে গাড়ির নেমপ্লেটও কৌশলে গাড়ির পেছনে এমনভাবে লাগিয়ে রাখে যে, ভুক্তভোগীর মালামাল নিয়ে চলে গেলে গাড়ির নম্বর দেখার সুযোগ থাকে না। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরপরই র্যাব, পুলিশ ও ডিবির পাশাপাশি পিবিআইও কাজ করছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ পাশের এলাকাগুলোতে বেশির ভাগ রিকশাযাত্রীদের টার্গেট করে তারা। যাত্রীদের কাছে থাকা ব্যাগ, ল্যাপটপ, মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি সুযোগ বুঝে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ছাড়া কখনো কখনো তাদের হাতে থাকা চাপাতি ও ছোরা ঠেকিয়ে রিকশার গতি রোধ করে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়।
চলন্ত রিকশায় যাত্রীদের কাছে থাকা ব্যাগ তাদের চলন্ত প্রাইভেট কার থেকে ছিনিয়ে নেয়ার সময় যাত্রীরা পড়ে গিয়ে আহত কিংবা নিহত হলো কি না সে বিষয়টি তাদের অজানাই থেকে যায়। ছিনতাইয়ের জন্য বেশির ভাগ সময় তারা ভোরের সময়টাকেই বেছে নেয়। শুক্র ও শনিবার বেশি ছিনতাই করে তারা। কারণ এ দু’দিন রাস্তাঘাট বেশি ফঁাঁকা থাকে। এক দিনে চার থেকে পাঁচটি ছিনতাইয়ের টার্গেট নিয়ে রাস্তায় বের হয় তারা। একটি প্রাইভেট কারে তারা তিন থেকে চারজন বের হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। প্রতিদিনই ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু গ্রেফতারের পর আইনি দুর্বলতার কারণে ছিনতাইকারীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের নির্মূল করা যাচ্ছে না। তবে পুলিশি অভিযানের কারণে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা কমে গেছে।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে নগরীর বিভিন্ন থানায় একাধিক ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। বেল্লালের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় হত্যা মামলাও রয়েছে। প্রায় ১১ বছর জেল খেটে জামিনে মুক্ত হয়ে গত এক বছর ধরে সে ছিনতাইয়ে জড়িত রয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, দোলাইপার-শ্যামপুর, সদরঘাট থেকে সূত্রাপুর-দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, গুলিস্তান থেকে পল্টন, সার্ক ফোয়ারা থেকে রমনা পার্ক, কাঁটাবন-নীলতে, পলাশী-আজিমপুর, ঝিগাতলা থেকে রায়ের বাজার-শঙ্কর, মিরপুরের রূপনগর-বেড়িবাঁধ, খিলতে থেকে বিমানবন্দর সড়ক, কালশী রোড, মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার, উত্তরা থেকে আব্দুল্লাহপুর, মোহাম্মদপুরের কলেজগেট থেকে রিংরোড, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে মিরপুর-১, আগারগাঁওয়ের সংযোগ সড়কে টানা পার্টি বেশ সক্রিয়।