আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে সরকার। রায়ে কী হতে পারে তা নিয়েও রয়েছে দুই মত। আদালতের বিষয় হওয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হবে নাকি তিনি খালাস পাবেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তবে এ মামলার রায় যা-ই হোক না কেন তার ফল ক্ষমতাসীনদের ঘরেই যাবে বলে মনে করছেন তারা।
নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, এ রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপি রাজপথ গরম করবে। আর আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও বা ভাঙচুর করলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মামলা দিয়ে ঘায়েল করা যাবে। সচল করা হবে পুরনো সব মামলাও, যা নির্বাচন পর্যন্ত চলতে থাকবে। এতে নির্বাচনের আগেই দলটি বড় ধরনের চাপের মুখে থাকবে। এ সুযোগে সরকারও সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে পারবে।
অন্য দিকে এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা না হলে বিএনপিও মাঠ গরম করতে পারবে না। এতে আদালতের ওপর বিএনপির যেমন আস্থা বাড়বে তেমনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক থাকবে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। সেসব মামলায় তার সাজা হলে বিএনপিও আর রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সে জন্য রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হোক বা খালাস পাক তা নিয়ে সরকারের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ রায়ের সুফল সরকারই পাবে বলে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে একধরনের গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতি। দেশের সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা হবে নাকি তিনি খালাস পাবেন তা নিয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে সবখানে। বিএনপি ইতোমধ্যে রায় নিয়ে মাঠে নেমেছে। গতকাল মঙ্গলবার অন্য একটি মামলায় আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরার পর হাইকোর্ট এলাকায় বিএনপির তিন নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। এ সময় ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা পুলিশি বাধার পরও প্রিজন ভ্যান থেকে ওই তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেয়। বিষয়টি প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
রায়ে দলটির শীর্ষ নেতার সাজা হলে দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে সরকারকে ইতোমধ্যে হুঁশিয়ার করছেন বিএনপি নেতারা। ওই দিন থেকেই সরকার পতন আন্দোলন শুরু হবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন তারা। দলীয় প্রধানের সাজা হলে নেতারাও স্বেচ্ছায় জেলে যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। ফলে সাজা হলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে শঙ্কিত বিভিন্ন পেশার মানুষ। তারিখ ঘোষণার পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে একাধিক বৈঠক করেছেন। বৈঠক হয়েছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির।
এ ছাড়া সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খালেদা জিয়া বৈঠক করেছেন ২০ দলীয় জোট নেতাদের সাথেও। আগামী ৩ মার্চ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা ডাকা হয়েছে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে রায় পরবর্তী করণীয় নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোট। এসব বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। রায় নিয়ে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দেয়া নিয়ে বেশ উদ্বেগ রয়েছে সরকারেও।
এ দিকে রায় নিয়ে বিএনপি যেমন প্রস্তুতি নিচ্ছে তেমনি বসে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। ইতোমধ্যে সারা দেশে সাংগঠনিক সফর শুরু করে দিয়েছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। ১৫টি টিমে ভাগ হয়ে তৃণমূল চষে বেড়াচ্ছেন তারা। এসব সভা-সমাবেশের মাধ্যমে দলের তৃণমূলকে চাঙ্গা করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হচ্ছে। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি যাতে মাঠে নামতে না পারে সে জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
গতকাল সিলেট সফরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হজরত শাহজালাল (রহ:)-এর মাজার জিয়ারত ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বোধনের পাশাপাশি সেখানে জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। ভাষণে তিনি খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। রায়কে কেন্দ্র করে ঘুমিয়ে থাকা বিএনপি আবার চাঙ্গা হচ্ছে। রায়ের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা বলা মুশকিল। তবে রায়ে সাজা হলে বিএনপি যদি নাশকতা শুরু করে তা মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া দলীয়ভাবেও আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুইজন নেতা বলেন, এ মামলায় যে রায়ই হোক না কেন তার ফল সরকারের ঘরেই যাবে। রায়ে সাজা হলে বিএনপির যেমন বিপদ আবার খালাস পেলেও খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এ মামলায় খালাস পেলেও অন্য মামলায় তার সাজা হতে পারে। এ মামলায় সাজা না হলে তারা আদালতের প্রশংসা করে হয়তো বলবেন, সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আদালত ন্যায় বিচার করেছেন। কিন্তু পরের মামলায় সাজা হলে আর বিরোধিতা করতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার ঘরোয়া বৈঠকে খালেদা জিয়াকে এক কম্বলে ঘুমাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি তথ্য ছাড়া কোনো কথা বলেন না। তাই খালেদা জিয়ার অপরাধের জন্য একবারের জন্য হলেও জেলে যেতে হবে। সেটা এ মামলায় হতে পারে আবার অন্য মামলায়ও হতে পারে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, রায় কী হবে তা আদালতের বিষয়। বর্তমানে আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন। সে জন্য রায় যেটাই আসুক আওয়ামী লীগ তা মেনে নিবে। তবে রায়ে সাজা হলে বিএনপি কোনো ধরনের নাশকতার অপচেষ্টা করলে তা সরকার কঠোর হাতে দমন করবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।