সারা দেশের রেজিস্টার্র্ড, নন-রেজিস্টার্ড এবং এনজিও পরিচালিত প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দীর্ঘ পাঁচ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। তিন ধাপে জাতীয়করণ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এখন শেষ ধাপের (তৃতীয় ধাপের) শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ নিয়ে চলছে টালবাহানা। তৃতীয় ধাপের বিদ্যালয়গুলোর গেজেট প্রকাশ করা হলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। কবে এ গেজেট প্রকাশ করা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নয়, খোদ প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই দফায় দফায় আপত্তি উত্থাপন করছে।
মন্ত্রণালয় ও শিক্ষক নেতাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ছয় মাস আগে মন্ত্রণালয় থেকে মাঠপর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছে যে, থানা, জেলা ও কেন্দ্রীয় টার্স্ক ফোর্স বিদ্যালয় ও শিক্ষক যাচাই-বাছাই কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তা আবার পাঠানোর জন্য। এতেই তৃতীয় ধাপের শিক্ষকদের জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ আটকে গেছে।
নানা চড়াই-উৎরাই এবং দফায় দফায় আপত্তির পর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের রেজিস্টার্র্ড ও নন-রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঘোষিত ও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ধাপের এনজিও পরিচালিত প্রাইমারি স্কুলসহ বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা গত ৫ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি।
শেষ ধাপের মাঠ জরিপকাজ ২০১৪ সালে শেষ হলেও মন্ত্রণালয়ে এখন এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা ধরনের টালবাহানা। বিষয়টি নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে মন্ত্রণালয়। তৃতীয় ধাপের শিক্ষকদের গেজেট কখন প্রকাশ করা হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। এ ধাপের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের আওতায় আসবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারীকরণের ঘোষণার পর পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই মন্ত্রণালয়ের।
নতুন এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে আবার মাঠপর্যায়ের রিপোর্ট তলবের পরিপ্রেক্ষিতে। এ রিপোর্ট গত ৬ মাসেও মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েনি। ফলে তৃতীয় ধাপের শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ পেছাচ্ছে। যদিও এই গেজেট প্রকাশের কথা ছিল ২০১৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে।
সারা দেশে তিন ধাপে মোট শিক্ষক এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন। গত ৫ বছর ধরে জাতীয়করণের মুলা ঝুলিয়ে রাখায় এসব শিক্ষক (তৃতীয় ধাপ) মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দ্রুততম সময়ে এ জটিলতার সমাধান বা জাতীয়করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা নয়া দিগন্তকে বলেন, আগামী জুনের আগে জাতীয়করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন বা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগবে।
এ দিকে এই তিন ধাপের শিক্ষকদের বেতনভাতা নিয়েও নানা জটিলতার কারণে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তারা অভিযোগ করেন, নির্বাচনের দোহাই দিয়ে জাতীয়করণ করা হলো অথচ এখন তারা না খেয়ে মরতে বসেছেন। আর্থিক অনটনে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধারদেনা করে সংসার চলছে না।
এর জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথম ধাপের শিক্ষকেরা ১ জানুয়ারি ’১৩ থেকে বকেয়াসহ সরকারি শিক্ষক হিসেবে বেতনভাতা পাচ্ছেন। দ্বিতীয় ধাপের শিক্ষকেরা জুলাই ’১৩ থেকে বকেয়াসহ বেতনভাতা পাবেন। আর তৃতীয় ধাপের শিক্ষকদের ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে পাওয়ার কথা। প্রথম ধাপেই শিক্ষক বেশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম।
উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে এমপিওভুক্ত ২২ হাজার ৯৮১টি বেসরকরি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারি আদেশও জারি করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। এসব স্কুল স্থায়ী/অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও নির্মিত/পরিচালিত। আর তৃতীয় ধাপে স্কুলগুলো হচ্ছে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ও পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষাধীন ৯৬০টি বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় আসবে।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির (জাতীয়করণকৃত) সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা গত পাঁচ বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক ও হতাশার। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি করা হলেও দীর্ঘ সময় পর তা শেষ হয়েছে। এখন তৃতীয় ধাপের বিদ্যালয়গুলোর গেজেট প্রকাশের পর শিক্ষকদের গেজেট প্রকাশ নিয়ে নতুন জটিলতায় শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে বিলম্ব করা হলে বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। এ ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
উল্লেখ্য, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘ ২২ বছরের দাবি আর আন্দোলনের মুখে ৯ জানুয়ারি ’১৩ জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সারা দেশের রেজিস্টার্র্ড ও নন-রেজিস্টার্ড এবং এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষকদের মহাসমাবেশে তিন ধাপে তাদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে বলেন, ‘সরকারের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তিন ধাপে জাতীয়করণ করা হবে।’