গাইবান্ধার মামুনুর রশীদ। চাকরি করতেন একটি প্রাইভেট ফার্মে। হঠাৎ চাকরি চলে যায় তার। তাই জীবিকার তাগিদে হন্যে হয়ে একটি চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। এক দিন একটি জাতীয় দৈনিকে লোভনীয় বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে তার। আকৃষ্ট হন তিনি। দেখা করেন বিজ্ঞাপনদাতা তানভীরের সাথে। সাড়ে ৪ লাখ টাকায় হংকং যাওয়ার স্বপ্ন দেখায় তানভীর। বেতন বাংলাদেশী মানের ৬০ হাজার টাকা। স্বপ্নে বিভোর মামুন জমি বিক্রি করে, শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা ধার করে নিয়ে দেন তানভীর ও নাজমুলের কাছে। ফ্লাইটের তারিখও পরে; কিন্তু হংকং যাওয়া হয়নি মামুনের। কারণ প্রতারক চক্রের চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি। শুধু মামুনুর রশীদই নন, এ রকম আরো বেশ কয়েকজনকে হংকংয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পার পাননি তারা। আটকা পড়েছেন সিআইডির জালে।
সিআইডি দাবি করেছে, বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে সহজ সাধারণ মানুষকে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রতারণা করে আসছিল একটি প্রতারকচক্র। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে তানভীর আহম্মেদ ও খিলক্ষেতের নামাপাড়া থেকে নাজমুল হাসান সুমনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে এ দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম। এ সময় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে চারটি মোবাইল সেট, আটটি সিম, দুই হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, একটি রাবার স্ট্যাম্প, একটি রেজিস্টার, আসামি তানভীরের তিনটি পাসপোর্ট, আসামি নাজমুলের একটি পাসপোর্ট এবং ব্র্যাক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের একটি করে চেকবই জব্দ করা হয়।
গতকাল মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম।
সিআইডি সূত্র জানায়, বিজ্ঞাপন দেখে এই প্রতারকদের দেয়া ফোন নম্বরে কেউ কল করলে হংকংয়ে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখাত তারা। অথচ তাদের নিজস্ব কোনো অফিস নেই। তারা অফিস না থাকার বিষয়টি আড়াল করে ক্লায়েন্টদের সাথে দেখা করত যমুনা ফিউচার পার্কের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। সেখানেই হংকং পাঠানোর জন্য মৌখিক চুক্তি করত। এরপর চুক্তি অনুযায়ী টাকা নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিদেশ না পাঠিয়েই লাপাত্তা হতো তারা।
নজরুল ইসলাম জানান, গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘ভিসা প্রসেসিং’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। যেখানে হংকংয়ের কিছু ভিসা প্রসেস করা হবে বলে জানানো হয়। যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া হয় উত্তরা, হাউজ বিল্ডিং, ঢাকা। সাথে দেয়া ছিল একটি ফোন নম্বর। সেই নম্বর দেখে যোগাযোগ করেন নারায়ণগঞ্জের জিয়াউল হক সুমন ও হায়াত আহম্মদ। তাদের সাথে প্রতারকেরা দেখা করে যমুনা ফিউচার পার্কের রেস্টুরেন্টে। হংকং পৌঁছার পর প্রত্যেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দিতে হবে বলে মৌখিক চুক্তি হয়।
তিনি আরো বলেন, ফ্লাইটের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। নির্ধারিত তারিখে যাত্রার আগে মোটা অঙ্কের একটা টাকা ডলারে এক্সচেঞ্জ করা হয়। ফ্লাইটের দিন দুই ভুক্তভোগী যে টাকা হংকং গিয়ে দেয়ার কথা ছিল, তা থেকে আট হাজার ডলার প্রতারকদের দিয়ে দেন। এরপর প্রতারকেরা ভুক্তভোগী দুইজনকে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। তারা একটু পর আসার কথা বলে ১ নম্বর টার্মিনালের দিকে চলে যায়। এরপর আর ফিরে আসেনি। ফোনে আসছি-আসছি বললেও কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফোন বন্ধ করে তারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত বছরের ১৪ নভেম্বর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করা হয়।
একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন গাইবান্ধার মামুনুর রশীদ। তিনিও বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে চার লাখ টাকা হারিয়েছেন। সিআইডি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, গত বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিজ্ঞাপন দেখে ওই নম্বরে যোগাযোগ করি। হংকংয়ে চাকরি অফার পেয়ে চার লাখ টাকার চুক্তি হয়। একই মাসের ১৭ তারিখ জানানো হয় সরাসরি হংকং যাওয়া যাবে না।
নেপাল হয়ে হংকং যেতে হবে। সেজন্য ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের টিকিট কেটে দেয়া হয়। যার ডিপারচার ডেট দেয়া ছিল ১৬ তারিখ। কথামতো ১৪ সেপ্টেম্বর ডলার এক্সচেঞ্জ করার কথা বলে চার লাখ টাকা নেয় প্রতারকেরা। ১৫ সেপ্টেম্বর রাতেও প্রতারকদের সাথে ফোনে কথা হয়। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রতারকদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফোনে ও কোথাও প্রতারকদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রতারণার শিকার হয়েছি, বিষয়টি বুঝতে পারি।
তিনি বলেন, তারা প্রথমে আমার বিশ্বস্ততা অর্জন করে। এরপর ভিসা প্রসেসিংয়ের কথা বলে প্রথমে ২০ হাজার। পরে চার লাখ টাকা নেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের জমি বিক্রি করে দুই লাখ এবং শ্বশুরের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ধার নিয়েছেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ১৭ সেপ্টেম্বর ভাটারা থানায় একটি জিডি করেন। এরপর সিআইডি দুই প্রতারককে গ্রেফতার করেছে এমন খবর পেয়ে সিআইডি কার্যালয়ে আসেন মামুনুর রশীদ।
তিনি বলেন, আমি বিজ্ঞাপন দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কারণ একটা ভালো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া মানে মনে করেছি, এরা প্রতারক হতে পারে না। তখন আমার একটা কাজ খুব দরকার ছিল। বেকার ছিলাম। মাথায় কিছু আসেনি। তিনি আরো বলেন, আমি চাই, পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন ছাপানোর আগে কর্তৃপক্ষ যেন যাচাই-বাছাই করে নেন।
নারায়ণগঞ্জের জিয়াউল হক সুমন ও হায়াত আহম্মদ এবং গাইবান্ধার মামুনুর রশীদের মতো আরো অনেক ব্যক্তিকে এভাবে হংকংয়ে পাঠানো কথা বলে সর্বস্বান্ত করেছেন তানভীর আহম্মেদরা। নিজেকে তিনি সাবেক সেনাকর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এ ধরনের প্রতারণায় তার সহযোগী ছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান ওরফে সুমন।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃতরা দুই দিনের রিমান্ডে রয়েছে। এর মধ্যে তানভীরের অ্যাকাউন্টে ১৯ লাখ টাকা পাওয়া গেছে, যা সে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে প্রতারণা করে হাতিয়েছে। তার অ্যাকাউন্টটি জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডির সিনিয়র পুলিশ সুপার (মিডিয়া) শারমীন জাহান বলেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত আরো চারজন প্রতারিত হওয়া ভিকটিম আমাদের কাছে এসেছে। তাই এ মুহূর্তে সর্বমোট কত পরিমাণ টাকা এই দ্ইু প্রতারক হাতিয়ে নিয়েছে বলা সম্ভব হচ্ছে না।