আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান ও নবায়ন কর্মসূচি জোরদার করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নতুন ভোটার ও নারীদের বিশেষভাবে টার্গেট নিয়ে কাজ করছে ক্ষমতাসীনেরা। ভোটে এই দুই ধরনের লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতারা। ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ লাখ সদস্য ফরম বিতরণ করা হয়েছে বলে দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তবে চিহ্নিত চাঁদাবাজ, উগ্রবাদী-সন্ত্রাসীসহ অবাঞ্ছিতরা যাতে সদস্য হতে না পারে সে দিকে বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে। এই ধরনের কাউকে কোনোভাবেই সদস্য পদ না দেয়ার ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। একই সাথে এসব অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে এমন এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের ব্যাপারে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আমলে নেবে দলটির হাইকমান্ড- এমন আভাস পাওয়া গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ মে গণভবনে দলের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সদস্যপদ নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এর আগে এ কার্যক্রম গতিশীল করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ১৮ মার্চ সারা দেশে সাংগঠনিক সফর শুরু করেন। এরপর সদস্য সংগ্রহ অভিযানের গতি আরো বাড়াতে ৩ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সারা দেশের সাংগঠনিক জেলায় চিঠি ইস্যু করেন। চিঠিতে যেসব সাংগঠনিক জেলা/মহানগর/ উপজেলা/ থানা/ পৌর শাখা ফরম সংগ্রহ করেনি অতিদ্রুত তাদের আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডি রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে তা সংগ্রহ করে এলাকায় সদস্যপদ সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচি জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়।
কিন্তু তাতেও গতি পায়নি সদস্য সংগ্রহ অভিযান। এর কারণ হিসেবে একাধিক নেতা জানান, শোকের মাস আগস্ট। এই মাস জুড়ে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে হয়। এ ছাড়া বন্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক ব্যস্ত সময় পার করেছেন। দেশের অর্ধেক জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রের প্রায় সব শক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে। এরপর হঠাৎ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে পালিয়ে আসে। তখন রোহিঙ্গাদের ঢল সামাল দেয়া অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে দল ও সরকারের জন্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব ঘোষিত সদস্য পদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচিতে ভাটা পড়ে। যদিও ইতোমধ্যে সদস্য সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচিতে গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে বলে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন। একাধিক নেতা জানান, এবারের সব পরিকল্পনা হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের টার্গেট ঘিরে। আগামী নির্বাচনে জয়ের বিকল্প নেই।
আর নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তরুণ ও নারী ভোটারেরা। তাই নতুন সদস্য করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের টার্গেট হচ্ছে নারী ও নতুন ভোটার। যদিও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারপরও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় নতুন সদস্য সংগ্রহ ও পুরনোদের নবায়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাজধানী ঢাকাতেও এ কর্মসূচি জোরদার করার লক্ষ্যে গত ১৭ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন ওবায়দুল কাদের। এরপর ৭ নভেম্বর কামরাঙ্গীর চর, ১৩ নভেম্বর পল্টন কমিউনিটি সেন্টারে এবং ১৬ নভেম্বর আজিমপুর পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ গতিশীল করার জন্য একই কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয়।
এ দিকে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে আজ অবধি কার্যক্রম শুরু না হলেও নেতাকর্মীরা অপেক্ষায় রয়েছেন। শিগগিরই এই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা বলেছেন থানাপর্যায়ের একাধিক নেতা। এ প্রসঙ্গে ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা-৪ আসনের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু জানান, থানা ও ওয়ার্ডে এখনো নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়নের বই আসেনি। আসামাত্র আমরা কার্যক্রম শুরু করে দেবো। তিনি বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুসারে সদস্য করার ক্ষেত্রে নতুন ভোটার ও নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তবে কোনো মাদকসেবী, সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদীর সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন কাউকে কোনোভাবেই সদস্য করা হবে না। ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৫ আসনের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী মশিউর রহমান মোল্লা সজল তার সাংগঠনিক থানায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম শুরু করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, একটু সময় লাগছে। ইতোমধ্যে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নোতাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। সজল বলেন, হাইব্রিড ও কোনো ধরনের অনাকাক্সিত লোক যেন নতুন সদস্য হতে না পারে সেজন্য আমরা সর্বদা সতর্ক আছি। পাশাপাশি দলের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে এমন হাইব্রিড ব্যক্তিদের যাতে সদস্য পদ নবায়ন করা না হয় সে জন্য হাইকমান্ডকে আমরা অনুরোধ জানাব।
একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ হচ্ছে দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল। এ দলের কাছে মানুষের অনেক আশা-আকাক্সক্ষা রয়েছে। তাই দলকে আরো পরিচ্ছন্ন করতে এবার নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচির দিকে সবাইকে নজর রাখতে হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার হিড়িক পড়েছে। অতীতে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে অনুপ্রবেশকারীরা দলের জন্য তিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই এবার একটি সিস্টেমের মাধ্যমে দলে অন্তর্ভুক্ত করানো হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন অনেক সতর্ক।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, কোনো চিহ্নিত চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী এবং সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির দোসর আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবে না। নতুন সদস্য সংগ্রহে আমাদের টার্গেট প্রথম ভোটার যারা হয়েছেন তারা ও নারী ভোটার। তরুণ ও নারী ভোটারদের সদস্য করা আমাদের টার্গেট।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, যারা নতুন ভোটার হয়েছে তাদের আমাদের দলের পক্ষে আনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। নতুন ভোটাররা তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরুষেরা যতটা সক্রিয় নারীরা ততটা নয়। আর সে কারণেই নারীদের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নারীদের সহজেই মানুষ বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে। আমরা চাই না তারা কোনো ভ্রান্তির মধ্যে থাকুক। তাদের রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া দেশে পুরুষের চেয়ে কিন্তু নারী ভোটার কম নয়। এই দুই ধরনের ভোটার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।