বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় রাজধানী ঢাকার প্রাণ। শত উদ্যোগেও অবৈধ দখলের কবল থেকে মুক্তি মিলছে না বুড়িগঙ্গার। দিন দিন বাড়ছে অবৈধ দখল ও দূষণের মাত্রা। প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর প্রায় ১৮ কিলোমিটারই অবৈধ দখলদারদের কব্জায়। এসব কারণে মৃত প্রায় এই নদীটিকে লাইফ সাপোর্টে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে বলা যায়। এ ছাড়া হাজারীবাগ এলাকার কালো দুর্গন্ধময় পানির উৎকট গন্ধে নদীর পাড়ে মানুষ অতিকষ্টে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন সবচেয়ে বেশি কালো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষাক্ত পানি ও উৎকট গন্ধ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এদিকে বুড়িগঙ্গাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে গত কয়েকদিন আগে কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ এলাকায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, বারবার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে বুড়িগঙ্গার চার কিলোমিটার এলাকা অবৈধ দখলদার মুক্ত করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত এলাকায় একটি পার্ক ও নদী তীরবর্তী কিছু এলাকায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
গতকাল সরেজমিন নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাশ ঘিরে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে বসতঘর ও শিল্পকারখানা। স্থানীয় প্রভাবশালী ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সহায়তায় ভরাট হচ্ছে এই বুড়িগঙ্গা। নির্মিত হচ্ছে পান্না ব্যাটারি ও ম্যাটাডোর ব্রাশের মতো বড় বড় শিল্পকারখানা। নদীর পাড় দখল করে নির্মিত হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। নদী ভরাট করে আরও দখল করে তৈরি করা হয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড, ইট, বালু ও পাথরের ডিপো। বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে উচ্চ আদালতের বারবার নির্দেশের পরও ঢাকার কণ্ঠহার বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা-প্রশাখার দুই তীর আবারও দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে একাধিক নেতার সহায়তায় নদীর বুকে বালু ভরাট চলছে। চলছে নদী ভরাটের মহোৎসব। স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে থাকছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কামরাঙ্গীরচর বউবাজার থেকে সোয়ারী ঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা ও শাখা নদীতে তিনশর বেশি পাকা, আধাপাকা, বাঁশের তৈরি ঘর নদীর বুক ও পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নদী ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা। কিছু অসাধু অর্থ লোভী লোক নিজেদের জমি দখলে রাখতে শহীদনগর বেড়িবাঁধের অপর প্রান্তে নির্মাণ করেছে হাসপাতাল। এদিকে সিটি করপোরেশনের ময়লা যত্রতত্র না ফেলে তাদের নিজস্ব ডিপোতে ফেলার কথা। কিন্তু তা না করে সময়, শ্রমিক, অর্থ বাঁচাতে গাড়িভর্তি ময়লা সিকশ্যানের ব্রিজের ওপর থেকে সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীর বুকে এবং ভরাট করা নদীর বুকে মুহূর্তের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে পাকা ও আধাপাকা ঘর ও দোকান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারদিকের নদী দখল ও দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প, টাস্কফোর্সের সভা ও সিদ্ধান্তের মত কোনো কর্মসূচি কাজে আসছে না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ থাকলেও বুড়িগঙ্গার মৃত্যু ফাঁস হিসেবে পরিচিত হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো এখন পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বুড়িগঙ্গার দখল-দূষণ রোধে কোনো পদক্ষেপই বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। নদীতে এক ধরনের ফেনা ভাসে, এটা আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গা নদীতে ২৫৭টি তরল বর্জ্য লাইনের তালিকা আছে। দুই মাসের মধ্যে এই বর্জ্যমুখগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। নিজেরা না করলে আমরাই এগুলো বন্ধ করে দেব।
সবুর মিয়া নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, গত বছর পানি যেমন কালো ছিল, এবার তার চেয়ে বেশি কালো ও ঘন মনে হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার পানির দূষণের মাত্রা তেমন বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। মামলা করেও কোনো ফল হচ্ছে না। নদীর আশপাশের মানুষগুলো যেন নির্বিকারভাবে সহ্য করছে এসব অসহনী দুর্গন্ধ।