নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেওয়ার আগে কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় পর্দার অন্তরালে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘আলোচনা ও সমঝোতা’ চায় বিএনপি। দলটি মনে করে, তাদের রূপরেখা যতই যুক্তিসঙ্গত হোক, ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করবে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, নির্বাচনকালীন রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত। দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও বুদ্ধিজীবী এ প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন। তবু রাজনৈতিক সমঝোতা হলে খসড়া রূপরেখায় পরিবর্তন আসতে পারে। বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরি করতে চায়। এ জন্য বারবারই সরকারকে সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে। কারণ একটি ন্যূনতম সমঝোতা হওয়ার আগে কোনো রূপরেখা ফলপ্রসূ হবে না বলে মনে করেন তারা।
রবিবার বিকালে এক আলোচনাসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক সুবিধান হলেই রূপরেখা দেওয়া হবে। দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, দেশের স্বার্থেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসেছিল। এবারও প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার অন্তরালে কূটনীতিক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতায় সরকার আলোচনায় বসবে বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যথাসময়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেব। কখন কী প্রক্রিয়ায় দেওয়া হবে তা সময় হলেই সবাইকে জানানো হবে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফাভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে ভোট হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও সুষ্ঠু হয়নি। ফলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না তা দেশি-বিদেশি সবাই জানে। এ অবস্থায় দেশে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে গেলে আলোচনা করেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। রূপরেখা তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক নেতা বলেন, কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আছে। সংবিধানের মধ্য থেকেই প্রস্তাব তৈরি করে একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে মাসখানেক আগে দলের স্থায়ী কমিটির এক সভায় নির্দলীয় সরকারের বাইরে অন্য কোনো প্রস্তাব না দেওয়ার পরামর্শ দেন কয়েকজন সদস্য। তখন এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে কিছু দ্বিমত তৈরি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াও সহায়ক সরকার শব্দটি এড়িয়ে এখন নির্দলীয় সরকারের দাবির পক্ষে কথা বলছেন। অবশ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক নেতা বলেন, প্রস্তাবগুলো যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তা সংবিধানের মধ্যে হলেও ব্যবস্থাটা হবে নির্দলীয়। জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়টিও জড়িত। দলটির নেতাদের শঙ্কা, যেভাবে খালেদা জিয়ার মামলার বিচারকার্য দ্রুত গতিতে এগোচ্ছেÑ এটি সরকারের ইশারা ছাড়া সম্ভব নয়। নির্বাচনে অযোগ্য করতেই জিয়া চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্টের ভিত্তিহীন মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হতে পারে। গত শুক্রবার কক্সবাজারের চকরিয়ায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেনÑ ‘অপেক্ষা করুন আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অন্যায়ভাবে জেলে নিয়ে যে নির্যাতন করেছেন, তাকেও তার ফল ভোগ করতে হবে।’ এ মন্তব্যকে সিরিয়াসলি নিয়েছে দলটি। খালেদা জিয়া নিজেও এর সমালোচনা করে টুইট করেছেন। দলের নেতারা বলছেন, প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য বিএনপির শঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে কী করবে বিএনপি এমন প্রশ্নে দলের এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, সেক্ষেত্রে দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। বিএনপি তখন রাজপথে সোচ্চার হবে। আন্দোলনে গেলে আলোচনা এবং রূপরেখা বাদ দিয়ে সরকার পতনের একদফার দিকে যেতে হবে তাদের। জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ প্রসঙ্গে শনিবার এক আলোচনাসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেনÑ এটি খুব ভালো কথা। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বলে আমাদের সংবিধানে কোনো কিছু নেই; অর্থাৎ তিনি সংবিধান থেকে একটু বেরিয়ে এসেছেন। তা হলে একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এখন। নির্বাচনকালীন সরকার যেহেতু সংবিধানে নেই, তা হলে আমরা ধরে নেবÑ সংবিধানের বাইরে এসে তিনি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা চিন্তা করছেন। যদি তাই হয়, আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাব, সহযোগিতা করব। তখন সবাই মিলে একটি সমঝোতার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কয়েকজন জানান, আলোচনার টেবিলে বর্তমান সংসদ ভেঙে আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের শর্তে নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ‘ছুটিতে’ পাঠিয়ে অথবা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠনÑ মোট তিনটি প্রস্তাবনা দিয়ে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। তিনটি রূপরেখার মধ্যে প্রথম দুটি সংবিধানের আলোকেই করা। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আলোচনার টেবিলে ক্ষমতাসীনদের যদি কোনো ভালো রূপরেখা থাকে তা মানতে বিএনপি আপত্তি করবে না। ওই আলোচনার টেবিলে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রেখেছে। যদি ওই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়, তা হলেই দেশবাসীর সামনে সংসদ ভেঙে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী থাকলেও আমাদের আপত্তি থাকবে না। তবে তা আলোচনার ভিত্তিতে হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রীদের সবাই নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তার রুটিন কাজের বাইরে কোনো কর্মকা- করতে পারবেন না। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা অবশ্যই দেওয়া হবে। এটি তো আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি দেশের জনপ্রিয় দল হিসেবে আমাদের কর্তব্য। রূপরেখা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নে আলোচনার ক্ষেত্রও তৈরি করা হবে।