কিছুদিন আগে বেদগ্রাম থেকে যাচ্ছিলাম গোপালগঞ্জ শহরের লঞ্জ ঘাটের দিকে। রাস্তায় খুব জ্যাম কবরস্থানের কাছে। ভোগান্তি পোহাতে না পেরে হাঁটা ধরলাম। রিকশাওয়ালা মামারা ভাড়াটা মন মতই চেয়ে নিচ্ছিল। তাদের মধ্যে খুবই আনন্দঘন মুহুর্ত দেখা গেল তখন। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, তারা একজন আরেকজনকে বিদ্রুপাত্মক ভাবে রোহিঙ্গা বলে সম্মোধন করছে- ‘দেশটা রোহিঙ্গায় ভরে গেছে’, ‘এই রোহিঙ্গা’- এই শব্দগুলো অকপটেই মুখে আসছিল তাদের। বিষয়টা অনেকেই উপভোগ্য করে তুলছিল। রিকশা নিয়ে যখন লঞ্ঝঘাটের দিকে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল অনেকের মুখেই রোহিঙ্গা শব্দটি লেপে রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর মত একটি মানবিক, স্পর্শকাতর বিষয়কে আমরা বুলিতে পরিণত করেছি। বাহবা দেয়ার মত বিষয়ই বটে! তাই নয় কি? রাস্তাঘাটে, পথেঘাটে, চায়ের দোকানে এই কথাগুলোর প্রচলন চোখে পড়ার মত। এতদিন কিছুসংখ্যক নিম্নশ্রেণীর মানুষের বুলি হলেও ইদানিং সংখ্যায় কিছুটা বেড়েছে। বিষয়টি অবশ্যই গা-চাটাচাটি করার মত বিষয় নয়! তবে ইতিবাচকও নয়। সরকারের দুর্বলতা, বিভিন্ন তারকাদের অশালীনতা, সরকারি আমলাদের উদ্ভট কথাবার্তা প্রায় সময় কঠিন ভাবে সমালোচিত হয়। কখনো কখনো সেগুলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল হতেও দেখা গেছে। লোকমুখেও সমালোচিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে এমনকি ভবিষ্যতেও হবে। সেটা স্পর্শককাতর বিষয় নয়। সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে যাচ্ছে জনগণের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে। যেকোন মূল্যেই তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে এই অবস্থানেও সরকার অনড় আছে। বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া সত্ত্বেও এখনো কোন সঠিক সুরাহা পাওয়া যায়নি। কিভাবে তাদের দেশে নিবে মিয়ানমার সরকার তারও কোন সদুত্তর মেলেনি। আশা রাখা যায় আমরা অচিরেই এর একটি প্রক্রিয়া দেখতে পাব। আমরা যখন একজন আরেকজনকে বিদ্রুপাত্মক ভাবে রোহিঙ্গা বলে ডাকি সেটা কতটুকু আমাদের উচিত, সেটিই আলোচ্য বলে মনে করছি। রোহিঙ্গা শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক। নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য ‘রোহান’ বা ‘রোহাং’ নামে প্রচলিত ছিল। এই রোহাং থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভবের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটির সঠিক সময়কাল জানা যায়নি। এছাড়াও আরেকটি প্রচলিত ধারণা অনুসারে সমুদ্রে একবার জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। যারা বেঁচেছিল তারা কুলে এসে বলেন “আল্লাহর রহমতে বেচে গেছি”। এই রহমত শব্দটি থেকেও রোহিঙ্গা শব্দটি আসতে পারে। সর্বোপরি একটা গোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। যারা কিনা নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত সংখ্যালঘু মিয়ানমারের মুসলিম সম্প্রদায়। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের স্থান দিয়েছি এবং ঠিক মানবিক কারণেই তাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সহানুভূতি, দায়িত্ববোধের পরিচয় আমরা দিয়েছি। একটি নামই ভাল-খারাপ ইঙ্গিত বহন করতে সক্ষম যুগ যুগ ধরে। এর জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট- ‘মীর জাফর’ বা ‘মির্জাফর’। এই নামটির সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার মত কিছু নেই। এই একটি নামই যদি শত শত বছর ধরে একটা খারাপ ইঙ্গিত বহন করতে পারে। নামটা শুনলেই সবার শারীরিক এবং মানুষিক ভংগির নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তাহলেও রোহিঙ্গা নামটিও কম কিসে? কিন্তু এই গোষ্ঠীটা এমন কোন খারাপ ইঙ্গিত বা এমন কোন কাজ করেনি যার জন্য এই নামটিকেও ‘মির্জাফর’ এর যোগ্য অনুরূপ হিসেবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। আমরা কিছুসংখ্যক মানুষ হয়ত এখন সেই চর্চাই করছি। পরিশেষে বলতে চাই, আমরাই সরকার, আমরাই জনগণ, আমরাই বাংলাদেশ। আমরা বিশ্বের যেকোন সম্প্রদায়কে নিজের করে নিতে পারি। আমাদের কম থাকা সত্যেও রোহিঙ্গাদের বিশাল একটা গোষ্ঠীকে ভরণপোষণ করছি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আদি উত্তরসূরি থেকেই আমরা একটি উদার জাতি। কেউ কাঁদলে আমরা কাঁদি। কেউ হাসলে আমরা হাসি। আমরা তাদের কটাক্ষ না করে যদি আরেকটু ভালবাসা বাড়িয়ে দেই সেটিই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়- আমরা বাংলাদেশি।