‘দুই বেলা খাওন পায় না আবার মেয়ে খেলব ফুটবল’—কথাটি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু কখনোই ক্লান্ত হননি। তিনি পরিশ্রান্ত হননি বলেই হাতের তালুতে বেড়ে ওঠা মেয়েদের পায়ে দেশের নারী ফুটবল আজ এগিয়ে যাচ্ছে, অদম্য গতিতে। অজপাড়াগাঁয়ের এক সাধারণ মানুষ, মফিজ মাস্টার। নামটি চেনা চেনা লাগছে, তাই না? হ্যাঁ, ময়মনসিংহ জেলার সেই কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের কথাই বলা হচ্ছে।
তাঁর হাতেই ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কলসিন্দুরে বোনা হয়েছিল নারী ফুটবলের চারা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের বাবা-মাকে কতশতভাবে বুঝিয়ে গাছটি বুনেছিলেন তিনি। সেই চারা আজ বেড়ে উঠেছে, হয়েছে বটবৃক্ষ। কিন্তু মফিজ মাস্টারের গায়ে সে গাছের ছায়া পড়ে না। বড্ড অভিমান করে বসে আছেন ‘মাস্টার সাহেব’।
ধুলো ওড়া অন্ধকার জনপদে ফুটবলের ফুল ফুটিয়েছেন মফিজ মাস্টার। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মেয়েদের জড়ো করেছেন ফুটবল মাঠে। প্রথমে থ্রিপিস গায়েই চলত অনুশীলন। অনুশীলন শেষে মেয়েদের পৌঁছে দিতেন ঘরের উঠোন পর্যন্ত গিয়ে। শুধু তা-ই নয়, দারিদ্র্যের বেড়াজালে বড় হয়ে ওঠা মেয়েদের জন্য ডিম-কলার ব্যবস্থা হতো তাঁরই পকেট থেকে। এরা যে তাঁর মেয়ের মতোই। শক্ত মাঠে মেয়েদের অনুশীলন করতে কষ্ট হয়, রাত জেগে মাঠে পানিও দিতেন। এলাকার মানুষেরা বলতেন, ‘মফিজ মাস্টার পাগল হয়ছেনি।’ আসলে মাস্টার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর মেয়েরা হবে চ্যাম্পিয়ন।
ধরাও দিয়েছিল স্বপ্নটা। ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফুটবলের সৌজন্যে কলসিন্দুরের নাম পৌঁছে গেল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে। এরপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে শিরোপা জিতে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে স্কুলটি। কলসিন্দুর নামটি পৌঁছে যায় তখন মানুষের ঘরে ঘরে। স্বাভাবিকভাবে সেই সঙ্গে অনন্যসাধারণ মফিজ মাস্টারের নামটাও।
এতেই বুঝি পড়ল কলসিন্দুরে গায়ে ‘অসুন্দরের’ ছায়া! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে, তা অনেকে মেনে নিতে পারল না। এলাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের পা পড়লেই সবাই খোঁজেন মফিজ মাস্টারকে, জ্বলে উঠল হিংসার আগুন। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে তৈরি হলো বিভেদ। মেয়েদের ডেকে বলা হলো, মাধ্যমিকের ছাত্রীরা প্রাথমিকের মফিজ মাস্টারের কাছে যেন অনুশীলন না করে। নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো নানা বদনাম। তত দিনে তাঁর তিল তিল করে গড়ে তোলা সব মেয়েই পা রেখেছে মাধ্যমিকে। অর্থাৎ মেয়েদের কাছ থেকে কৌশলে আলাদা করে দেওয়া হলো মফিজ মাস্টারকে।
সেই থেকে মফিজ মাস্টারের অভিমান, ছাত্রীদের কাছে কেন ছোট করা হলো তাঁকে। সে অভিমানেই প্রায় দেড় বছর ধরে ফুটবলের বাইরে। ফলাফলটাও হয়েছে যাচ্ছেতাই। হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলটি শেষ দুই বছরে টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক পর্বই পেরোতে পারেনি! ভাবা যায় কদিন আগেই সোনা ফলানো কলসিন্দুর স্কুলের এই দুরবস্থা!
‘দেড় বছর ধরে মাঠের বাইরে আছি। মাঝে জেলা প্রশাসক স্যারের সম্মানে শেষ দুই বঙ্গমাতার সময় মাঠে নেমেছিলাম। সামনে আর নামতে চাই না। আমি সবার শত্রু হয়ে গিয়েছি। আমার মেয়েরাও তো আমার আর নেই। মেয়েদের অভিভাবকদের ডেকে বলে দিয়েছি, আমি আর মেয়েদের দায়িত্ব নিতে পারছি না। মেয়েদের আপনাদের হাতে বুঝিয়ে দিলাম।’ অদম্য মফিজ মাস্টারের কণ্ঠে কষ্ট। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার উপায়ও তো নেই।
তাঁর অনুপস্থিতিতে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ফুটবলের আঁতুড়ঘরটি। এক তরুণ কোচের অধীনে শুধু চলছে মাধ্যমিক স্কুল দলের অনুশীলন, ভালোই চলছে। কিন্তু মেয়েদের চোখে স্পষ্ট দেখা গেছে মফিজ স্যারকে ফিরে পাওয়ার আকুতি। তাদের স্যার যে তারকা তৈরি করতে জানেন। ফিরবেন মফিজ মাস্টার? ‘আমার হাতেই শুরু মেয়েদের ফুটবল। ওদের প্রতি আমার চেয়ে বেশি দরদ আর কার! কিন্তু একটা মানুষ কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে এমন সিদ্ধান্ত নেয়, বুঝতেই পারছেন। আত্মমর্যাদার কথা ভেবে ফুটবল থেকে দূরে আছি।’ তাঁর বুকে জমে আছে অভিমানের পাহাড়। তাই তো রাগ করে বলতে পারলেন, ‘এখন মাঠে যেতে হয় না, পরিবারকে সময় দিতে পারি। এখন বিকেলে বাজারে গিয়ে টাটকা শাকসবজি কিনতে পারি। আগে মেয়েদের অনুশীলনের জন্য পারতাম না। অনেক ভালোই আছি!’
একদিকে তাঁর গড়ে তোলা মেয়েদের নিয়ে চলছে শিরোপা উৎসব। অন্যদিকে তাঁর বুকের মধ্যে বইছে হাহাকার। এটি স্পষ্টত নারী ফুটবলের জন্য অশনিসংকেত। কলসিন্দুর একদিনে গড়ে ওঠেনি, সবাই কিন্তু মফিজ মাস্টার নন!