সাধারণ লোকজনের ‘অসাধারণ ফুটানি’ এইবার শেষ। এইবার তারা বুঝতে পারছে আমি কী জিনিস। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, অথচ সময় নাই অসময় নাই বাড়ির বউ-ঝিকে ঝাড়ি মারে—‘ডাইল বাগার দেও কী দিয়া শুনি? পেঁয়াজ কই? পেঁয়াজ কম থাকে ক্যান? আমি কি ফকির হয়া গেছি? যখন ডাইলে বাগার দিবা আধা মাইল দূর থাইক্যা জানি পেঁয়াজের বাসনা পাই। পেঁয়াজ দিবা গায়েরে হিসাব। দরকার পড়লে খালি পেঁয়াজের তরকারি রান্না করবা!’
কী মেজাজ ছিল! বাবারে! পয়সার গরমে তারা আমাদের ‘পেঁয়াজ’ বলেই মনে করত না। মসলা থেকে আমাদের টেনে সবজির কাতারে নামিয়ে এনেছিল প্রায়।
মানির মান আল্লায় রাখে। এখন লাফালাফি বন্ধ। পয়সার গরম ঠান্ডা হয়ে গেছে। কেদ্দানি করে সকালে উঠে পান্তার সাথে আমাদের আঙুলের ডগায় দুমড়ায়ে মুচড়ায়ে কচ কচ করে খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে গেলে এখন ভদ্দরলোকেরাও আমাদের গোনায় ধরে। ধরে, মানে ধরতে হয়। নইলে বাজারের অন্য আইটেমের টাইমলি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়।
খুচরা বাজারের কেজিপ্রতি দাম হিসাবে আনলে আল্লাহর রহমতে আমাদের বংশমর্যাদা এখন শেখ, সৈয়দ, মুঘল, পাঠানেরও সাত মাকাম ওপরে। আর গভীরতা তো সাগরের কাছাকাছি। পর্তুগিজ অভিযাত্রী ফার্দিনান্দ ম্যাজেলান নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের তল মাপতে দড়ির মাথায় কামানের গোলা বেঁধে ডুবিয়ে দেখছিলেন। গোলা ডুবতে থাকল। ম্যাজেলান দড়ি ছাড়তে থাকলেন। জাহাজের দড়ির গোডাউন খালি হয়ে গেল। কিন্তু তল পাওয়া গেল না।
আমার তল পাওয়ার চেষ্টায় এ পর্যন্ত বহু বেকুব একের পর এক আমার খোসা ছাড়িয়েছে। ঝাঁজের চোটে পোয়া খানিক চোখের পানি ঝরিয়েছে। কিন্তু আমি আপস করি নাই। নিজে ‘নাই’ হয়ে গেছি, কিন্তু তল পেতে দেইনি। আর এখন তো ‘ফকির্যা পার্টি’ আমাদের খোসা ছাড়ানোর সাহসই পাবে না।
বাঙালির ভাতের অভাব এখন আগের মতো নাই। কিন্তু পেঁয়াজের অভাব কী পরিমাণ বাড়ছে তা তারা ‘বোন টু বোন’, আই মিন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এখন আর বাঙালি হা-ভাতে নয়। বাঙালি এখন হা-পেঁয়াজে।
বর্তমান বাজারে আমাদের পেঁয়াজ সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটো গোষ্ঠী আছে। একটা দেশি। আরেকটা ইন্ডিয়ান।
স্থানীয় গুন্ডাপাণ্ডার চোটপাট বেশি থাকে। লোকাল হওয়ার সুবাদে এলাকায় তারা বহিরাগত ভাড়াটে বাসিন্দাদের চেয়ে দাম পায় বেশি। বঙ্গ সংস্কৃতিতে যার চোটপাট, মানে হ্যাডম, মানে ঝাঁজ যত বেশি, তার দাম তত। তাকে তত বেশি মানুষ ডরায়। দেশি পেঁয়াজ যেহেতু লোকাল, সেহেতু স্থানীয় প্রভাবের কারণে তার ঝাঁজ বেশি। তার চোটপাট বেশি। তাই আইনত তার দাম বেশি। জাতির বিবেকের সামনে তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন উঠতে পারে—দাম বেশি মানে কত বেশি?
ধরুন আপনি ছা-পোষা চাকরিজীবী। আপনার ঝাঁজ নাই। হ্যাডম নাই। চোটপাট নাই। উপরি-টুপরি নাই। ‘আউট ইনকাম’ নাই। মাসে এক দিন, মানে বেতন পাওয়ার দিন বা তার পরের দিন বউ-বাচ্চা নিয়ে অ্যামিউজমেন্ট পার্কেটার্কে যান; কোনো কোনো মাসে সাহস করে রুফটপ রেস্টুরেন্টে তাদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। মাসের বাকি দিনগুলো টিফিন ক্যারিয়ার হাতে বাসে ঠাসাঠাসি করে অফিসে যান। একই তরিকায় বাসায় ফেরেন।
আপনার মতো এই লেভেলের ঝাঁজওয়ালা লোক যদি দেশি পেঁয়াজের লোকাল ঝাঁজ হিসাব ছাড়াই টেস্ট করতে যান, তাহলে তো অঙ্ক মিলবে না। আর অঙ্ক না মিললে টের পাবেন ‘হাউ মেনি প্যাডি মেক হাউ মেনি রাইস!’
এক শ টাকার ওপরে পেঁয়াজের কেজি শুনলে অ্যাবাউট টার্ন করা ছাড়া আর কোনো পথ আপনার সামনে থাকবে? ফলে আপনি আমাদের বিকল্প গোষ্ঠীকে খুঁজবেন।
এই ‘বিকল্প’ গোষ্ঠী হলো ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ। তারা ট্রাকে চেপে, কাস্টমসে নানা জায়গায় সেলামি (আসলে আক্কেলসেলামি) দিয়ে বর্ডার পার হয়। তারপর আবার ঘাটে ঘাটে সেলামি দিতে দিতে বাজারে আসে। তাদের দেখতে যতই নাদুশনুদুশ মনে হোক, আসলে তারা অত কাজের না। এমনিতেই বহিরাগত বলে ঝাঁজ মানে চোটপাট কম, তারওপর দীর্ঘ ভ্রমণজনিত হেনস্তা। ফলে তার দাম কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা আমরা নিখিল বঙ্গ পেঁয়াজ সম্প্রদায় মেনেও নিয়েছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের এই গোষ্ঠীও চাটুজ্যে-বাড়ুজ্যের মানসম্মান পেয়েছে। যে পেঁয়াজের দাম ছিল ১৫-২০ টাকা, মাস ছয়েকের ব্যবধানে তার দাম এক শ টাকা ছুঁইছুঁই। মধ্যবিত্তের কপাল ভালো, এখনো রোজার মাস আসেনি। আসলে তারাও বুঝত, পেঁয়াজে ছুলে কত ঘা!
আমি একা না, উইকিপিডিয়াও বলেছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসের আদি যুগ থেকেই আমাদের ব্যবহার শুরু। পৃথিবীর প্রায় সবখানে, সব সমাজের রান্নায় আমরা আছি। আমাদের কোষের আকার বড় বলে বিজ্ঞান শিক্ষায় মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার ও কোষের গড়ন শেখাতে আমাদের কন্ট্রিবিউশন আছে। অথচ কেউ এত দিন আমাদের মূল্যায়ন করেনি। শেষ পর্যন্ত আমদানিকারক, আড়তদার, মজুতদার, খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারের বড় বড় মানি লোকেরা যৌথ প্রযোজনায় আমাদের মান বাড়িয়েছেন। আমাদের জাতে তুলেছেন।
সংসারে আমাদের সীমাহীন গুরুত্বের বিষয়টি বুঝতে পেরে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও আমাদের প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক প্রশ্নপত্রে ট্রান্সলেশন করতে বলা হয়েছে: ‘আজকাল হাতিরপুল কাঁচাবাজারে ১২০ টাকা সের দেশি পেঁয়াজে একটা বড় পরিবার ভালোরূপে চলে যায়।’ রোজকিয়ামত হয়ে যাবে কিন্তু জিপিএ-৫ হাতছাড়া হবে না—এমন এক অমিত সম্ভাবনাময় মেধাবী শিক্ষার্থী এর উত্তরে লিখেছে, ‘Today tomorrow Elephantpull green market 120 Sher country_e onion a big wife goes well.’
সমাজে আমাদের এই প্রতিষ্ঠায় শুনছি সরকার বাহাদুরের কিছু লোকের অবদান আছে। এতে আমরা যারপরনাই বিগলিত হয়েছি। এটুকু সহযোগিতা না পেলে তাদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা হারাতাম। আমাদের আজকের মানসম্মানটুকু না থাকলে তো আর ‘নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে মুখ বাহির করিবার জো-টি থাকিত না।’ এই মান্যগণ্য স্যারদের প্রতি পেঁয়াজ সম্প্রদায়ের ঝাঁজালো সংগ্রামী শুভেচ্ছা থাকল।