হস্তী সন্ত্রাস

Slider বিনোদন ও মিডিয়া

38dbe1ac51dde5ad0369a1deb2645050-5a406948397ea

 

 

 

 

 

 

 

সন্ধ্যার দিকে একটু হাঁটব বলে বেরিয়েছি, মোড়ে আসতে না–আসতে বউয়ের ফোন, ‘কচি একটা লাউ এনো তো।’

বাসায় কিছু বলবে না, রাস্তায় বের হলেই শুধু এটা চাই-ওটা চাই। কিন্তু কচি লাউ কোথায় পাই? চিমটি কাটলে মনে হয় কচি, বাসায় আনলে সেটা হবে দড়কচা, নয়তো দেখা যাবে এক কোণে পচা!

কাটতে বসে বুয়া পান-খাওয়া কেলেছোপ দাঁত বের করে হাসে, ‘খালু লাউ কিনতে পারে না। বাটপারের গুষ্টি ঠকায়!’ আর তখনই চোঁ করে ওর চাঁদি গরম। ঝাঁজিয়ে ওঠে, ‘চোখ যে এদের থাকে কোথায়!’ বুয়া তখন দরদ দেখায়, ‘খালু সরল-সিদা মানুষ, হেরে কিছু কইয়েন না, খালা! আমরাই বাটপারগো লগে পারি না!’

এই দুঃখে লাউ কিনতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই আমার কাঁধেই এই জোয়াল চাপাবে!

এক পা-দু পা করে রুমেল মিয়ার সবজির দোকানের দিকে এগোই। মিনিট পাঁচেকের পথ। যেতে যেতে কয়েকটা ফাস্ট ফুডের দোকান পড়ে। এগুলো আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে। আয়-রোজগার বাড়ছে মানুষের। এসব দোকান তার প্রমাণ। চাপ-পরোটা, নান-কাবাব, মসলা-দোসা—এসব খাবার দেদার বিক্রি হয়। টিনএজ জুটিরা এগুলো গালে পুরে কথার খই ফোটায়। একটা সময় ছিল, যখন ছোঁড়া-ছুঁড়ি পার্কে গিয়ে ঝোপের আড়ালে বসে চানাচুর বা বাদাম খেতে খেতে গল্প করত, এখন ওরা এসবের ধার ধারে না।

হঠাৎ করেই নজরে আসে ব্যাপারটা। রাস্তার এক পাশে যানবাহন সব থেমে আছে। রেলগেটের দিকে যেসব রিকশা, স্কুটার, ভ্যান যাচ্ছে, সেগুলো লাইন ধরে থেমে আছে। একেবারে নট নড়নচড়ন। আবার ওদিক থেকে আসার জায়গাটা একদম ফাঁকা। কিছুই আসছে না। মানে, আসতে পারছে না। কিছু একটা হয়েছে। এসব ছোট রাস্তায় লরি বা বড় কোনো কাভার্ড ভ্যান ঢুকলে এই বিপত্তি ঘটে।

‘আহ্, এই রকম কইরো না তো, ছাড়ো!’

তাকিয়ে দেখি, জ্যামে গ্যাঁট হয়ে থাকা একটা রিকশায় কপোত-কপোতীর মতো বসে আছে এক জুটি। জিনসের প্যান্ট পরা স্মার্ট তরুণটি সযত্নে চুল ঠিক করে দিচ্ছে তরুণীর। প্রেমিকার সলাজ আপত্তি উপেক্ষা করে তরুণ বলছে, ‘এই সাহস নিয়া প্রেম করা যায় না। আরও স্মার্ট হও, পিংকি!’

হুঁ, রাস্তার মধ্যে যা দেখাচ্ছে, তরুণ সাহসীই বটে!

রুমেলের দোকানে গিয়ে দেখি টাগ অব ওয়ার। সেই লাউ নিয়েই। কচি এক লাউয়ের জন্য দুজনের বাগ্‌যুদ্ধ। লুঙ্গি পরা লোকটা বলছে, ‘আরে, এইডা আমি আগে থিকাই টার্গেট করছি!’

প্যান্ট পরা লোকটা বলছে, ‘আপনে টার্গেট করার আগেই আমি গুলি করছি। এই দ্যাখেন চিমটির দাগ!’

আচমকা মনে হলো, গোটা দুনিয়া যেন দুলে উঠল। দেখি, আস্ত এক কালো পাহাড় মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে! দেড় তলা সমান উঁচু ইয়া বড় এক হাতি হেলেদুলে আসছে।

কচি লাউটা দেখলাম দুম করে পড়ে গেল রাস্তায়। বাতচিতে মগ্ন দুজন দুদিকে দৌড়। আমিও আর দাঁড়াই কেন? তড়িঘড়ি পাশেই এক হাঁড়িপাতিলের দোকানে গিয়ে সেঁধোলাম।

চলন্ত পাহাড় বলে কথা! এক কদমে হাতি অনেকটা এগোয়। দেখতে দেখতে ওটা রুমেল মিয়ার দোকানের সামনে এসে গেল। শুঁড় দিয়ে টুপ করে লাউটা তুলে মুখে পুরে দিল দুই খদ্দেরের বিবাদ মিটিয়ে। তারপর ঘোঁৎ করে বিদঘুটে এক আওয়াজ করে শুঁড়টা বাড়িয়ে দিল রুমেল মিয়ার দিকে। ভয়ে আধমরা ছোকরা টিনের কৌটা হাতড়ে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিল হাতির দিকে। এত বড় প্রাণী, অথচ কেমন সুবোধ বালকের মতো নোটটা তুলে দিল পিঠে বসা মাহুতের হাতে।

আশ্রয়স্থল সুবিধার মনে হলো না। দ্রুত বেরিয়ে এলাম। ইলেকট্রিকের মালামাল বিক্রেতা ছটকু ভাইয়ের দোকানের দিকে ছুটলাম। রিকশার সেই রোমান্টিক জুটির মধ্যে জোরাজুরি শুরু হয়েছে। সাহসী তরুণ রিকশা থেকে নেমে তরুণীর হাত ধরে টানছে আর বলছে, ‘জলদি নাইমা পড়ো। ওই পাহাড় তো এক ডলায় শেষ কইরা দিব!’

তরুণী কোনো কথাই শুনছে না। বলছে, ‘না না, হাতিটা তো পোষা। ওটা আমাদের কিচ্ছু করবে না।’

‘তাহলে থাকো তুমি!’

এই বলে তরুণ দে ছুট। তরুণীও নামল এবার। বলল, ‘কী আশ্চর্য, আমারে একলা রাইখা যাও কই!’

ছটকু ভাই মুরব্বি মানুষ। ভারিক্কি একটা ভাব আছে। আমাকে হন্তদন্ত হয়ে দোকানে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘বিষয় কী, এত পেরেশান ক্যান?’

আমি মূর্তিমান বিপদের কথা বললাম। ছটকু ভাই নাক ফুলিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন না, এইটা নতুন এক ধান্দাবাজি! হস্তী দিয়া চান্দাবাজি! হস্তী–সন্ত্রাস! এত্ত বড় জানোয়ার লইয়া দোকানে গেলে ডরে কেউ কিছু কইতে পারে না। নগদ কিছু দিয়া বিপদ থিকা খালাস হয়। এইগুলারে ধইরা প্যাঁদানি দেওয়া উচিত। পুলিশ কী করে?’

এই বলে দোকানের ছোকরাকে দিয়ে আমার জন্য চা আনতে পাঠালেন ছটকু ভাই। বললেন, ‘এই বয়সে এত ডরানডা ঠিক না, ভাইজান। সাহস হইল মেইন। আমার দোকানে হাতি আইলে তো টাকাপয়সা কিছুই দিমু না। হাতি শুঁড় তুললে মাহুতরে কমু, নিচে নামো। তোমার হাতে টাকা দিমু। তারপর যেই না ব্যাটা নামব, দুই গালে কইষা দুই থাপ্পড়!’

ঠিক এমন সময় কালোমতো একটা জিনিস ইউ আকৃতি নিয়ে সামনে হাজির। ছটকু ভাইয়ের ঠিক বুকের হাতখানেক দূরে এসে স্থির হলো শুঁড়টা। পেছনে ইয়া বড় এক জ্যান্ত কালো পাহাড়!

ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ করল হাতি। ‘ইয়া মাবুদ’ বলে আর্তনাদ করে উঠলেন ছটকু ভাই। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিতে লাগলেন। তাঁর ডান হাতটা যেন তাঁকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে গেল ক্যাশের ড্রয়ারে। কী তুলে আনলেন, নিজেও হয়তো জানেন না।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগল ঘটনা ঘটতে। হাতিটা চলে যেতেই আবার আর্তনাদ করে উঠলেন ছটকু ভাই।

‘ইয়া মাবুদ, পুরা এক শ টাকাই তো দিয়া ফালাইছি! কী গজব কারবার!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *