জন্মের প্রায় ৪৫ বছর পর জন্মভূমিতে পা দিয়ে শামা জামিলা মলি হার্ট বেশ আনন্দিত। কানাডার নাগরিক শামার জন্ম বাংলাদেশে, ১৯৭২ সালের ৪ মে। মাত্র তিন মাস বয়সেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, কারণ এই দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর গর্ভধারিণী মা ত্যাগ স্বীকার করলেও সন্তানের বেড়ে ওঠার দায়িত্ব বহনের সক্ষমতা তাঁর ছিল না। হয়তো সেই ক্ষমতা ছিল না এই সমাজেরও। ফলে মলির মতো ১৫ জন নবজাতককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল সুদূর কানাডায়।
আমাদের এখানে মলির মতো সন্তানদের পরিচয় ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে। গতকাল রোববার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ছিল মলি হার্টের আলাপচারিতা। সেখানেই বক্তারা দাবি তুললেন মলিদের মতো সন্তানেরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁদের মায়েদের ত্যাগের ফলেই আজ আমরা স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করেছি। কাজেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই সন্তানদের খুঁজে এনে সম্মানিত করা। তাঁরা চাইলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া।
আলাপচারিতা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সন্তান নুজহাত চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বহ্নিশিখার শিল্পীদের দুটি সমবেত গান দিয়ে।
১৯৭২ সালে কানাডার ১৪টি পরিবার ১৫টি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেয়। সন্তানের স্নেহ-মমতায় তাদের লালনপালন করে। সেই শিশুদের মধ্যে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি। সেই আগ্রহ থেকেই শামা জামিলা মলি হার্টের বাংলাদেশে আসা। গত শুক্রবার তিনি তাঁর সপ্তম গ্রেডের শিক্ষার্থী মেয়ে সাবানা বনেলকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। তাঁদের ঢাকায় আসার ব্যাপারে উৎসাহিত এবং যাবতীয় ব্যবস্থা করেছেন যুদ্ধশিশুবিষয়ক গবেষক মুস্তফা চৌধুরী।
মলি হার্ট বলেছেন, কৈশোর পেরোনোর পরে তাঁর বাবা-মা জোয়েল হার্ট ও ট্রুডি হার্ট জন্মের বিষয়টি তাঁকে জানিয়ে দেন। এই দম্পতির ঔরসজাত সন্তান একজন এবং দত্তক নেওয়া সন্তান আটজন। এই নয় ভাইবোন তাঁরা এমনভাবে বড় হয়েছেন যে সেখানে আপন-পর বলে কোনো বোধ তাঁদের ভেতরে ছিল না। মলি ইংরেজি সাহিত্যে শিক্ষা শেষে মন্ট্রিলের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
আলাপচারিতায় মলি বললেন, গর্ভধারিণীর কথা তিনি অনেক ভেবেছেন। তাঁর প্রতি খুবই অন্যায় করা হয়েছিল। তিনি নিরুপায় ছিলেন। গর্ভধারিণীর প্রতি মলির কোনো ক্ষোভ, অভিযোগ নেই, বরং গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান রয়েছে। যদিও কোনো দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না, তবু তাঁর জন্য সহানুভূতি থাকবে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে মলি বলেছেন, তিনি কানাডার নাগরিক। তবে বাংলাদেশ যদি তাঁকে নাগরিকত্ব দিতে চায়, তবে তিনি সানন্দেই তা গ্রহণ করবেন। তবে এ জন্য কী করতে হবে তা তাঁর জানা নেই। বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা তাঁর অনেক দিন থেকেই ছিল। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। এখন থেকে মাঝে মাঝে এখানে আসার ইচ্ছা আছে। এ দেশের লোকের আন্তরিকতা ও প্রকৃতি তার মন ছুঁয়ে গেছে। কাল যাবেন (আজ সোমবার) পুরান ঢাকার ইসলামপুরের মিশনারি অব চ্যারিটিতে, যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই জায়গাটি দেখতে।
মুস্তফা চৌধুরী বললেন, কানাডার যুদ্ধশিশুদের নিয়ে তিনি প্রায় ২০ বছর থেকে গবেষণা করছেন। বাংলাদেশের জাতীয় আর্কাইভে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। কানাডার জাতীয় আর্কাইভ থেকে তিনি তথ্য সংগ্রহ করে যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর একটি বই একাত্তরের যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৭২ সালে প্রথম দলে ১৫ শিশুকে কানাডায় দত্তক দেওয়া হয়। মলি হার্ট প্রথম দলের একজন।