রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নৌকার প্রার্থী সাবেক মেয়রের ভরাডুবি হলেও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল বিজয়ী হওয়ায় ফলাফল নিয়ে আলোচনা একটু বেশি মাত্রা পেয়েছে।
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি। তার দেয়া আগাম ঘোষণা অনুযায়ী প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন জাপা প্রার্থী মোস্তফা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। অপর দিকে একপ্রকার ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী কাওছার জামান বাবলারও।
গত বৃহস্পতিবার রংপুর সিটিতে দ্বিতীয়বারের মতো ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। রাতেই মেয়র পদের ফলাফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। চূড়ান্ত ফলে জাপার প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এক লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শরফুদ্দিন ঝন্টু পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে ঝন্টুকে পরাজিত করে রংপুরের নগরপিতা হয়েছেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
এই নির্বাচনে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন হয়েছে চতুর্থ। এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারসহ বাকি তিন প্রার্থীর ভোটের পরিমাণ পাঁচ হাজারের কোটা পার হয়নি। ভোটের ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয়ের নেপথ্যে দলের একটি অংশকে দায়ী করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। ওই অংশ প্রচারণা চালিয়েছে, কেন্দ্র থেকে ঝন্টুকে জয়ী করার বিষয়ে কোনো সিগনাল নেই। জাপা ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটা সমঝোতা হয়েছে। যে কারণে তারা জাপা প্রার্থীর পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন। গতকাল শুক্রবার নিজ বাসভবনে এই সমঝোতার ইঙ্গিত দেন পরাজিত মেয়র প্রার্থী ঝন্টু। সরাসরি বিষয়টি না বললেও একটি জাতীয় পত্রিকার সংবাদকে রেফার করেন ঝন্টু। আওয়ামী লীগের এই হারের পেছনে দলীয় সিদ্ধান্তহীনতাসহ জাতীয় রাজনীতির প্রভাব রয়েছে বলে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনারুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনকে নিয়ে দল আর প্রার্থীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। তা ছাড়া সিটি এলাকার ভোটার আর সাধারণ মানুষের সাথে প্রার্থীর যে সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন, তা ছিল না। এগুলোই আসলে এই নির্বাচনে তার (ঝন্টু) পরাজয়ের প্রধান কারণ।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করীম রাজু বলেন, দলের নেতাকর্মীরা যদি কাউন্সিলর পদে ভোট আদায়ে ব্যস্ত থাকাসহ প্রতিপরে হয়ে কাজ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। কোনো নেতাকর্মীর ভূমিকায় অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শরফ উদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয়ের কারণ হিসেবে অনেক ভোটার বলছেন, ঝন্টু কথা দিয়ে কথা রাখেন না। তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রংপুর নগরীর উন্নয়নে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখেননি। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের সাথেও কোনো যোগাযোগ রাখতেন না ঝন্টু। ফলে তিনি দলের বাইরে সাধারণ ভোটারদের কাছে টানতে পারেননি বলেই তার এমন পরাজয়।
নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। সে সময় সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু (মোটরসাইকেল) এক লাখ ৬ হাজার ২২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্র্থী জাপা থেকে বহিষ্কৃত মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা (হাঁস) ভোট পান ৭৭ হাজার ৮০৫টি। এ ছাড়া বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা (আনারস) ২১ হাজার ২৩৫ ভোট, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের গোলাম মোস্তফা ১৫ হাজার ৬৮১ ভোট এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাফিয়ার রহমান সফি (দোয়াতকলম) চার হাজার ৯৫৪ ভোট পান।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলেও সাধারণ কাউন্সিলর পদে এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল। মেয়র পদে বিজয়ী জাতীয় পার্টির পরিচয়ে তাদের কাউন্সিলরের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতেই জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। আর জাতীয় পার্টি জিতেছে সাতটিতে এবং বিএনপি জিতেছে ছয়টিতে।
অপর দিকে একপ্রকার ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী কাওছার জামান বাবলার। বৃহস্পতিবার দলের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, কারচুপির মাধ্যমে তাকে হারানো হয়েছে এবং জাপা ও আওয়ামী লীগকে এ জন্য দায়ী করেন তিনি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। যদিও বিএনপির প্রার্থীর এই পরাজয়ের নেপথ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তার দলের নেতারা।
বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, রংপুরে বিএনপিতে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। এখানে সবাই শুধু কথা বলে। কিন্তু মাঠে কেউ কাজ করতে চায় না। শুরু থেকেই মাঠে থাকলে বিএনপির প্রার্থীর হারটা সম্মানজনক হতো।
তাকর্মীদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। প্রার্থীর পে প্রচারণা ছিল খুব কম। দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা কাউন্সিলর পদ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মেয়র পদের নির্বাচনে মনোযোগ ছিল না নেতাকর্মীদের। দলের সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণেই মূলত নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েছে। এ নির্বাচনে জোটগতভাবেই মাঠে নামা হয়নি বিএনপির। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর মূল দলের সাথে অঙ্গদলের কোনো সমন্বয় না থাকায় ফলাফলে এমন ভরাডুবি।
স্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিএনপির অনেক নেতাই মাঠে কাজ করেননি। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে থাকতে হবে। কোনোভাবে তৃতীয় হওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় নেতারাই প্রথম হওয়ার ব্যাপারে কোনো আশা দেখাতে পারেননি। বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনের ব্যাপারেও ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন মহানগর বিএনপির এক নেতা। রংপুর সিটিতে একবারে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। নির্বাচনী প্রচারণাও চালায় স্বল্পপরিসরে। এমনকি ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রার্থীর পক্ষে এজেন্ট দেয়া হয়েছে একেবারেই দায়সারাভাবে। যেসব কক্ষে দু’জন করে এজেন্ট থাকার কথা সেসব কক্ষে একজন করে দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির পে সমন্বয়ক দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর অবস্থা ভালো ছিল না। এ কথা এর আগেও বলেছি, এখনো বলছি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতবে না বলেই তারা কৌশলে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে জিতিয়েছে। কারণ আমি প্রচার-প্রচারণার সময় মাঠে থেকে দেখেছি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কী অবস্থা। সমন্বয়হীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপির সাথে সমন্বয় করে ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গদলগুলো কাজ করেছে। এখানে সমন্বয়হীনতার অভাব আছে বলে আমি মনে করি না।