চারদিকে অথই জলরাশি। তার বুকে এক টুকরা ভূমি। সকাল থেকে সন্ধ্যা হরেক পাখির অবাধ বিচরণে মুখর। সূর্যের আলোতে চিকচিক করে ঢেউ খেলে যায়। বালিয়াড়িতে ঝরা শিউলি ফুলের মতো বিছিয়ে আছে অসংখ্য লাল কাঁকড়া। নীল দিগন্তের মাঝে এ এক অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। এ যেন এক ভিন্ন বাংলাদেশ।
সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার গঙ্গামতী থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গভীর সাগরে জেগে উঠেছে এমনই মনোমুগ্ধকর এক দ্বীপ। সম্প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের একটি দল দ্বীপটির সন্ধান পায়। জেলেদের মুখে বিবরণ শুনে ৫ ডিসেম্বর তারা এই দ্বীপে যায়।
জেলেরা স্থানীয়ভাবে দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘হাইরের চর’। ‘হাইর’ হলো মাছ ধরার জন্য জেলেদের নির্ধারিত সীমানা। তবে পর্যটক দলের সদস্যরা দ্বীপটির নাম দিয়েছেন ‘চর বিজয়’। বিজয়ের এই মাসে আবিষ্কার বলেই এই নাম। দ্বীপে তাঁরা জাতীয় পতাকাও উত্তোলন করেছেন।
দ্বীপ চরটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণের সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করতে কুয়াকাটার স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগসহ বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন নিয়ে পৌর প্রশাসন গত বুধবার চরটি পরিদর্শন করেছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন চরের নামকরণ করা হয় চর বিজয়।
দ্বীপে যাওয়া পর্যটকদের দলটিতে ছিলেন ঢাকার সীমা আক্তার (৩৪) ও তাঁর স্বামী। সীমা আক্তার বলেন, ‘আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। কিন্তু গভীর সমুদ্রে এমন নয়নাভিরাম একটি দ্বীপ আছে, সেটা কল্পনাও করিনি। কী যে ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। যেন এক অন্য ভুবন। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না, আমাদের দেশে এমন একটি দ্বীপ আছে।’
স্থানীয় জেলেদের বর্ণনা মোতাবেক, বর্ষাকালে পুরো দ্বীপটি সাগরের জলরাশিতে ঢাকা পড়ে যায়। শীত মৌসুমে উঁকি মারে। এ সময় প্রান্তিক জেলেরা এই দ্বীপে যান। তাঁরা ডেরা তৈরি করে মাছ শিকার ও শুঁটকি করার জন্য এখানে তিন মাস থাকেন। দ্বীপটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার; প্রস্থে ৩ কিলোমিটার। তবে জোয়ারের সময় দৈর্ঘ্যে ৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ১ কিলোমিটার হয়।
গঙ্গামতী এলাকার জেলে আলতাফ হোসেন বলেন, সাধারণত গঙ্গামতী ও কাউয়ার চর এলাকার জেলেরা ওই এলাকায় মাছ ধরেন। বছর পাঁচেক আগে থেকে চরটি দৃশ্যমান হতে থাকে। ক্রমে এটি জাগতে থাকে এবং বছর দুয়েক আগে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকেই জেলেরা মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরির জন্য এই দ্বীপে আসছেন।
‘কুয়াকাটা সি ট্যুরিজম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ওই পর্যটকের দলটি সম্প্রতি দ্বীপটিতে যায়। দলে ঢাকার কয়েকজন পর্যটকের পাশাপাশি কুয়াকাটার বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকও ছিলেন। কুয়াকাটা সি ট্যুরিজমের কর্মকর্তা ও কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি জনি আলমগীর বলেন, ‘কুয়াকাটার অদূরে এত সুন্দর একটি চর জেগে আছে, তা আগে আমাদের অজানা ছিল। জেলেদের কাছে শুনে আমরা সম্প্রতি একটি দল নিয়ে ওই চরে যাই। চরের সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করে। বিজয়ের মাসে এই চর আবিষ্কার হওয়ায় আমরা এর নতুন নাম দিয়েছি চর বিজয়।’
পর্যটক দলের সদস্যদের বর্ণনা অনুযায়ী, লাল কাঁকড়া আর গাঙচিলসহ হরেক পাখির বিচরণ ও ওড়াউড়িতে দিনভর মুখর থাকে চরটি। সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের সময় অপরূপ দৃশ্যের দেখা মেলে। তবে দ্বীপে কোনো গাছপালা নেই। শুধু বালু আর বালু।
পর্যটক দলের সদস্য কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, ‘চর বিজয়ে গিয়ে দেখলাম, অজানা-অচেনা প্রচুর পাখির কলরব আর লাল কাঁকড়ার বিচরণ। এসব দৃশ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। তাই চর বিজয়কে পর্যটনের আওতাভুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আ. বারেক মোল্লা বলেন, ‘উদ্যমী কয়েকজন আলোকচিত্রী ছবি তুলতে গিয়ে জেলেদের কাছে এই চরের খবর পান এবং তাঁরা বিষয়টি জানালে স্থানীয় পর্যায়ের সর্বস্তরের লোকজন নিয়ে এই নতুন চর পরিদর্শনে আসি। যেহেতু বিজয় মাসে এই চরে এসেছি, তাই সবাই মিলে এই চরের নামকরণ করা হয় চর বিজয়। এ ছাড়া ওই দিনই অতিথিরা সবাই মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চরে ৫০০ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করি।’
এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ ১৫ ডিসেম্বর বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের গভীরে নতুন একটি দ্বীপের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। সরকারি গেজেট অনুযায়ী নদী কিংবা সাগরে চর জাগলে সেটা সংরক্ষিত বন হিসেবে গণ্য হবে। অচিরেই আমরা সেখানে যাব এবং খোঁজখবর নেব। পরিদর্শনের পর আমরা সেখানে বনায়নের উদ্যোগ নেব।’