ছেলেকে যেভাবে বাঁচালেন বাবা

Slider চট্টগ্রাম

342f60fa8afdc94f90a360a2130f7687-5a3accf990785

 

 

 

 

 

প্রচণ্ড ভিড় আর হুড়োহুড়ির মধ্যে ছেলে অন্ময় বড়ুয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন বাবা আশীষ বড়ুয়া। হাজারো মানুষের চিৎকার আর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কিছুতেই যাতে হাত ফসকে ছেলে দূরে চলে না যায়, সারাক্ষণ সে চেষ্টাই করে গেছেন তিনি। একটা সময় সামনে ও পেছনের দিক থেকে প্রবল ধাক্কায় নিজেকে আর সামলাতে পারেননি আশীষ বড়ুয়া। পড়ে যান মাটিতে। তাঁর পিঠের ওপর দিয়ে কতজন যে হেঁটে চলে গেছে…। উপুড় হওয়া অবস্থায় ছেলে অন্ময় ছিল ঠিক তাঁর বুকের নিচে। কারও পায়ের আঘাতে ছেলে যাতে কষ্ট না পায়, তখনো সে চেষ্টা করে গেছেন তিনি।

ওই অবস্থায় কেউ একজন ঝুঁকি নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা আশীষ বড়ুয়ার বুকের নিচ থেকে ছেলে অন্ময়কে কীভাবে যেন টেনে বের করে আনেন। পরে তাঁকেও উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন তিনি। বুকের একটি হাড় ভেঙে গেছে তাঁর। পুরো শরীরে তাঁর ব্যথা। ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় বাঁচাতে পেরেছেন—এটাই এখন তাঁর সান্ত্বনা। ঘটনার পর থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অন্ময়ের চোখেমুখে এখন শুধু আতঙ্ক। মানুষের জটলা দেখলেই ভয় পায় সে। হাসপাতালে অসুস্থ বাবার পাশে সারা দিন বসে থাকে শিশুটি।

চট্টগ্রামের সদ্য প্রয়াত সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভক্ত ছিলেন নগরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আশীষ বড়ুয়া। কোনো দিন মিছিল–মিটিংয়ে না গেলেও তাঁর মৃত্যুর পর ভালোবাসার টান উপেক্ষা করতে পারেননি। ছোট ছেলেকে নিয়ে গত সোমবার দুপুরে তাঁর কুলখানির মেজবানে অংশ নিতে রীমা কনভেনশন সেন্টারে যান তিনি। সেদিন সেখানে পদদলিত হয়ে মারা যান ১০ জন। গুরুতর আহত হন আশীষ বড়ুয়াসহ অন্তত ৫০ জন।

আশীষ বড়ুয়ার স্ত্রী বীথি বড়ুয়া বলেন, ‘পায়ের নিচে চাপা পড়ে ১০ জন মানুষ মারা গেছে ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে। আমার স্বামী ও ছেলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারছে, এটাই অনেক। ছেলেকে যেভাবে তার বাবা বাঁচিয়েছে, এটা আর কী বলব।’

সেদিনের ঘটনায় আহত সাতজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁরা হলেন শিক্ষার্থী অর্পণ বিশ্বাস (২২) ও পোশাকশ্রমিক সুনীল দেবনাথ (৩৫)। দুজনই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অর্পণের জন্য পালা করে হাসপাতালে দিনরাত থাকছেন তাঁর সহপাঠীরা। তাঁদের আরেক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দীপঙ্কর দাশ রাহুল সেদিন পদদলিত হয়ে মারা যান।

 অর্পণ মাথায় ও বুকে আঘাত পেয়েছেন বলে জানান তাঁর বন্ধু ওমর ফারুক।

আইসিইউর চিকিৎসক মো. জোবায়েত চৌধুরী বলেন, সুনীল ও অর্পণের অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালোর দিকে।

চিকিৎসক আশার কথা শোনালেও পোশাকশ্রমিক সুনীলের স্ত্রী বাসন্তী দেবনাথের চোখেমুখে এখনো অনিশ্চয়তা। হাসপাতালে স্বামীর পাশে সারাক্ষণ বসে থাকেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমার তিনটি মেয়ে। জানি না কী হবে!’

হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন প্রিয়জিৎ বরণ বৈদ্য (৪৬) আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ। গতকাল তাঁকে আইসিইউ থেকে সাধারণ শয্যায় স্থানান্তর করা হয়। ওষুধের দোকানি প্রিয়জিৎ বলেন, প্রাণের টানে বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে যান তিনি। এ রকম কিছু হবে, এটা তো কল্পনাতেও ছিল না।

একই বিভাগে চিকিৎসাধীন পঞ্চাশোর্ধ্ব রামদুলাল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সেবক পদে চাকরি করছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকার সময় থেকে। তখন থেকেই এই নেতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। একই কারণে ছুটে যান মেজবানে। নগরের মোমিন রোডের সেবক কলোনির বাসিন্দা রামদুলাল বলেন, ‘উনি আমাদের খুব দেখতে পারতেন। কলোনির সবাই গেছে। আমিও গেছি।’ এই অবস্থার মধ্যেও মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারানোর আফসোস বিন্দুমাত্র কমেনি তাঁর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *