উৎপলদের টিনের বাড়িটি ঘিরে উৎসুক লোকজন ও সংবাদকর্মীদের জটলা। সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা চিত্তরঞ্জন দাস। আর ঘরে উৎপলকে খাওয়াচ্ছেন তাঁর মা বিমলা রানী দাস। কারও বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ নেই। নিখোঁজ ছেলেকে সুস্থ ফিরে পেয়েই খুশি বাবা-মা। আর উৎপল বললেন, কারা তাঁকে ধরে নিয়েছিল, তাদের পরিচয় তিনি জানতে পারেননি।
অপহরণের ২ মাস ১০ দিন পর গতকাল বুধবার ভোর পাঁচটার দিকে নরসিংদীর রায়পুরায় গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন ঢাকার সাংবাদিক উৎপল দাস। গতকাল দুপুরে তাঁর বাড়ির দৃশ্যটা ছিল অন্য রকম। সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন কেবল উৎপল। তিনি একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদক।
নরসিংদীর রায়পুরায় উৎপলকে ঘিরে যখন পরিবারের সদস্যরা আনন্দ মেতেছেন, তখন ঢাকার বনশ্রীতে মোবাশ্বার হাসান সিজারদের বাড়িতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক ৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। একই অবস্থা ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হওয়া কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদের পরিবারেরও। ইশরাক নিখোঁজ গত ২৬ আগস্ট থেকে।
মোবাশ্বারের বোন তামান্না তাসনিম গতকাল বলেন, উৎপল ফিরে আসায় তাঁরা খুব খুশি হয়েছেন। তাঁদের আশা, মোবাশ্বারও ফিরবেন।
ইশরাকের বাবা ব্যবসায়ী জামালউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘উৎপলের খবর শুনেছি। এখন ছেলের অপেক্ষায় আছি। তবে কোনো দিক দিয়েই খোঁজাখুঁজি ও চেষ্টার ত্রুটি রাখছি না।’
গত চার মাসে ১৫ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বা তাঁরা নিখোঁজ হন। এঁদের মধ্যে উৎপল, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়সহ চারজন ফিরে এসেছেন। র্যাব, পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ছয়জনকে। পাঁচজন এখনো নিখোঁজ। এঁদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ ও কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান রয়েছেন।
এদিকে গতকাল উৎপলদের নরসিংদীর রায়পুরার বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব দেখা গেল। উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে উৎপল তাঁর মাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘মা, আমি ভুলতার এক জায়গায় আছি। কিছু চিনতে পারছি না। কোনো গাড়িও পাচ্ছি না। কীভাবে আসব? তখন আমরা ঘুম থেকে জেগে গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিই। পরে জানতে পারি, ছেলেকে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। তারপর আমরা তাকে নিয়ে আসি। আমার ছেলে সুস্থভাবে ফিরে আসছে।’
উৎপলের মা বিমলা দাস বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে পেয়েছি, শান্তি ফিরছে। আর কোনো মায়ের বুকে যেন এমন আঘাত না লাগে। এমনকি আমি কোনো বিচারও চাই না। আমার ছেলেকে পেয়েছি, এতেই আমি খুশি।’
‘আমাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলে’
নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় শাহজালাল সিএনজি স্টেশন থেকে উৎপল দাসকে উদ্ধার করেন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম। তাঁকে উদ্ধারের খবর পেয়ে রাত আড়াইটার দিকে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে যান পরিবারের সদস্যরা। সেখান থেকে পুলিশের সহযোগিতায় তাঁর সহকর্মী ও পরিবারের লোকজন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এর আগে রাত দুইটায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে উৎপল দাস সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ১০ অক্টোবর দুপুরে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে গেলে আমার কাছে একটা ফোন আসে। আমার ব্যক্তিগত কাজের জন্য মোবাইল ফোনে টাকাপয়সার কথা চলছিল। এমন সময় পেছন থেকে একদল দুর্বৃত্ত আমাকে জাপটে ধরে চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলে। তারপর জঙ্গলের ভেতরে কোনো একটি স্থানে টিনের ঘরে আটকে রাখে। সেখানে রাতে শিয়াল ডাকাডাকি করত। ওরা মাঝে মাঝে বলত তোর কাছে অনেক টাকা, টাকা দে, তুই কার কাছ থেকে টাকা চেয়েছিস? তারা টাকার জন্যই আমাকে অপহরণ করেছে। তবে কে বা কারা অপহরণ করেছে, এ ব্যাপারে আমি জানি না। ওই ঘরে তিন বেলাই দরজার নিচ থেকে খাবার দেওয়া হতো। সেখানে চৌকি বা খাট ছিল না, মেঝেতে থাকতে হয়েছিল। ওই ঘরে অ্যাটাচড বাথরুম ছিল। সেখানে গোসল করতাম।’
অপহরণকারীদের আচরণে পেশাদারি ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। উদ্ধার হওয়ার পরপর ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে উৎপল দাস বলেন, ‘আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তিন-চার ঘণ্টা একটা গাড়িতে করে ঘোরানো শেষে এখানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু জানি না। আমাকে এখানে (আধুরিয়া) নামিয়ে দেওয়ার সময় আমার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে তারা বলেছে, আমরা যখন গাড়ি টান দেব, তখন তুই চোখ খুলবি। আমি যখন সিএনজি স্টেশনে ঘোরাফেরা করছিলাম, তখন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম গিয়ে আমাকে সিএনজি স্টেশন থেকে নিয়ে আসেন।’