বেহুলার আখ্যানে প্রেমের রূপটি তার অভিযাত্রায় সীমাবদ্ধ হলেও, সাবিত্রী আখ্যানে তা শুরু থেকেই স্পষ্ট। বিশেষত যখন শত নিষেধ সত্ত্বেও সুস্পষ্ট পরিণাম জেনেও সাবিত্রী সত্যবানেই মুগ্ধ হয় এবং তাকেই বর হিসেবে পেতে চায়। তখন আর তাকে শুধু ‘পতিব্রতা’ বা ‘সতী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। তখন সে হয়ে ওঠে প্রেমাকুল এক সত্তা। আর শেষ পর্যন্ত সত্যবানকে নিয়ে তার ফিরে আসাটা হয়ে ওঠে প্রেমেরই জয়, যা বিয়ে নামক চুক্তিটিকে, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখে।
অর্থাৎ বিয়ের স্থায়িত্ব মূলত প্রেমের দৈর্ঘ্য দ্বারাই নিরূপিত হতে পারে। আর জুটি বাঁধার শুরুতে চোখে সাত কিংবা শত কেন, হাজার জনমের স্বপ্ন যে কেউ দেখতেই পারে। এমনকি এও ভাবতে পারে, পছন্দের মানুষটির সঙ্গে আজ নয়, বহু বছর আগেই পরিচয় হয়েছে। সাধে তো আর কেউ ‘হাজার বছর তোমার সাথে ছিল পরিচয়’ বলে গান ধরে না।
সেমেটিক পুরাণ বলছে, নারী ও পুরুষ জন্মের আগ থেকেই জুটি বেঁধে আছে। বলা হচ্ছে, স্রষ্টা প্রথমে পুরুষ সৃষ্টি করলেন। আর তারপর তার বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়লেন নারীকে। এভাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ জোড়ায় জোড়ায় আসে পৃথিবীতে। অর্থাৎ এই যে বিয়ে, সঙ্গী হিসেবে একজনকে বেছে নেওয়া, তা আদতে প্রত্যাদেশ পালনের মতোই। সে হিসেবে কারও চোখের দিকে তাকিয়ে আরেকজন হাজার কেন, কোটি বছরের পরিচয় সূত্র খুঁজতে নেমে পড়তেই পারে। অন্তত প্রেম এতে গাঢ় বই হালকা হবে না।
আফ্রিকান বিশ্বাসেও বিষয়টি প্রায় অনুরূপ। মহাদেশটিতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিশ্বাসগত তুলনামূলক ফারাক থাকলেও মূলগতভাবে তা পবিত্র। আফ্রিকান ধারণা অনুসারে, নারী ও পুরুষের একটি যুগল সত্তা এই গোটা পৃথিবী ও তার প্রাণিকুলকে সৃষ্টি করেছে জোড়ায় জোড়ায়। এই জোড়ের একত্র হওয়ার প্রক্রিয়াটি পবিত্র। আফ্রিকান ধারণায় বিয়ে হচ্ছে নারী ও পুরুষের সৃষ্টি থেকে স্রষ্টায় রূপান্তরের মাধ্যম। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও জন্ম-জন্মান্তরের প্রসঙ্গটি এসেই গেল। এমন বিশ্বাস বা গাথার অস্তিত্ব প্রতিটি সমাজেই বর্তমান। বলার অপেক্ষা রাখে না, অধিকাংশ সমাজই নারী ও পুরুষের এই মেলবন্ধনকে মহিমান্বিত করতে কোনো কসুর করেনি। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বিয়ে নিয়ে সবার মধ্যে এখনো এক ধরনের রোমান্টিসিজম কাজ করলেও, ভিন্ন বাস্তবতাও সামনে হাজির। এখন আর গুটিকয় দেশ ছাড়া মানুষ মাত্রই বিয়ে অনিবার্য নয়। এমনকি সন্তানাদির মা-বাবা হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক চুক্তিটি না হলেও চলে অনেক দেশে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে আমেরিকায় জন্ম নেওয়া শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশের মা-ই ছিলেন অবিবাহিত। ফ্রান্সে এ হার ৫৯ শতাংশ। আর কলম্বিয়ায় ৮৪ শতাংশ। এমনকি যেই চিলিতে বিবাহবিচ্ছেদ এখনো বেশ কড়াকড়ি হিসেবে দেখা হয়, সেখানেও বিবাহবহির্ভূত সন্তান জন্মদানের হার এমনকি ওইসিডিভুক্ত (অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) ৩৫ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই তো কিছুদিন আগেই সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় তোলপাড় তুলে দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে সারলেন আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি ও রোকোজ্জু। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাটি তারা আরও আগেও সারতে পারতেন কিংবা পরেও। বিষয়টি এখন পুরোপুরিই নির্ভর করছে ব্যক্তির ওপর। বিয়েটা এখন ভালোবাসা উদ্যাপনের একটি উপলক্ষ হয়ে উঠছে।
সে যা-ই হোক, ঐতিহ্য মেনে এক অনাদি প্রেমের পরিণয় হিসেবে দুজনের বিয়ে তো হলো। কিন্তু এর স্থায়িত্ব কতটা। এ ক্ষেত্রেও বিয়েকে দুজনের আজীবন স্থায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা প্রতিটি সমাজেই লক্ষণীয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দমকা হাওয়ার খোঁজ আদতে কেউ জানে না; বিয়ে যেমন সত্য, বিচ্ছেদও সত্য।
দেশে দেশে বিবাহবিচ্ছেদ এখন আগের চেয়ে বেশি স্বীকৃতি পাচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের এই স্বীকৃতি পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। বিশ্বের বহু দেশেই এখন এটিকে সহজভাবে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষত দ্রুত উন্নতি করছে এমন দেশগুলোয় বিবাহবিচ্ছেদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোয় বিবাহবিচ্ছেদের হারও বাড়ছে। বিবাহবিচ্ছেদের হার এতটাই বেড়েছে যে, বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন স্বাস্থ্যের ওপর বিয়ের ইতিবাচক প্রভাব প্রমাণ করতে। ল্যানসেট, সায়েন্স থেকে শুরু করে সায়েন্সডেইলি খুললেই এমন ভূরি ভূরি গবেষণা নিবন্ধ নজরে পড়বে। মূলত চার্চ থেকে শুরু করে, রাষ্ট্র ও চিন্তকেরা বিবাহবিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হার নিয়ে শঙ্কিত। আর এই শঙ্কা থেকেই বিজ্ঞানীরা বিয়ের ইতিবাচকতা প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছেন।
বাংলাদেশেও কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। সারা দেশের হিসাব পাওয়া না গেলেও শুধু ঢাকার চিত্র দিয়ে বিষয়টি বোঝা যায়। উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৫৩০টি তালাক কার্যকর হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪৮০টি তালাক কার্যকর হয়েছে। যেখানে ২০১১ সালে এই অঞ্চলে মোট তালাক কার্যকর হয় ৪২১টি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৪-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত তালাকের নোটিশ পাওয়া গেছে ১৯৮টি।
অবশ্য বিয়ে নামক চুক্তিটির প্রতি সবারই শ্রদ্ধা রয়েছে। এমনকি যে যুক্তরাজ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার ২০১৬ সালে ছিল ৪২ শতাংশ, সেই দেশেরই ৯৩ শতাংশ তরুণ সাম্প্রতিক এক জরিপে বিয়ের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন। এটি এর শক্তিরই প্রমাণ। এই শক্তি ও দুর্বলতা দুই নিয়েই চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিবাহবিচ্ছেদ কি আজকের সমাজেই হঠাৎ করে হাজির হওয়া কোনো উপসর্গ? উত্তর সহজ এবং তা হচ্ছে ‘না’। অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ আজ যেমন সত্য, আগেও তাই ছিল।
‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ বইয়ে অতুল সুর বলছেন, ‘প্রাচীন বৌদ্ধ সমাজে পরস্পরের সম্মতি অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ হতো।’ বিশেষত সঙ্গীর দুরারোগ্য রোগের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের অনুমতি সঙ্গে সঙ্গেই মিলত বলে তিনি লিখেছেন। এ ছাড়া পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস থেকেও বিচ্ছেদ হতো। ছিল প্রাচীন গ্রিক সমাজ ও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে গড়ে ওঠা ইউরোপীয় সভ্যতায়ও। একইভাবে মুসলিম রীতিতে উভয় পক্ষই বিচ্ছেদের অধিকার ভোগ করে। আর ইসলাম-পূর্ব যুগের আরবেও এটি প্রচলিত ছিল। সে সময় প্রচলিত বিয়ের চারটি প্রথার প্রতিটিতেই বিচ্ছেদের চল ছিল। এর দুটিতে কর্তৃত্ব ছিল নারীর আর দুটিতে পুরুষের। এর একটির বিচ্ছেদ ঘোষণার পদ্ধতিটি বেশ মজার। সেখানে কোনো নারী যদি তাঁর বরের সঙ্গে থাকতে অসম্মত হন, তাহলে রীতি অনুযায়ী তিনি তার তাঁবুর মুখটি ঘুরিয়ে দেবেন। অর্থাৎ পূর্বদিকে মুখ থাকলে তা পশ্চিমে ঘুরিয়ে দেবেন। আর এটিই সঙ্গী পুরুষটির প্রতি তাঁর বিচ্ছেদের বার্তা।
আবার পুনর্বিবাহেরও চল ছিল এখনকার মতো। এই অঞ্চলে হিন্দুদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ নিয়ে হাড়-মাংস এক করে দেওয়ার বহু আগ থেকেই পুনর্বিবাহের চল ছিল। স্বয়ং নারদ বলছেন, আরও ভালো পাত্র পেলে তাতে কন্যাদান করা যেতে পারে। আর বিধবা বিবাহ নিয়ে তো কোনো কথাই নেই। বৌদ্ধ থেরিগাথায়ও নারী-পুরুষ উভয়ের পুনর্বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। যা হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ। মূল কথা হচ্ছে, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ, এর কোনোটিই নতুন নয়। তাই বিয়ের স্থায়িত্বের ভাবনাটি নিয়ে রোমান্টিক মনে যে কেউ যত যা খুশি ভাবতে পারে। তাতে বিয়ে ও তাতে আবদ্ধ দুটি পৃথক সত্তার বাস্তব জীবনে কোনো নড়চড় হবে না।